করোনা সংকটে কেমন আছে মধ্যবিত্তরা?

কে এম হুমায়ুন কবির:

চলমান করোনা সংকটে দেশের উচ্চ থেকে নিন্মবিত্ত শারীরিক না হলেও মানসিকভাবে ভালো নেই কেউ। কারণ সবারই মনে এক অজানা প্রশ্ন, কখন শেষ হবে এ মহামারী?
এই প্রশ্নে উত্তর হয়তবা জানা নেই কারো। একমাত্র সৃুষ্টিকর্তাই ভালো জানেন এ প্রশ্নের উত্তর। তারপরেও সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করে পথচলতে হবে। রহমত ও ক্ষমা চাইতে হবে যাতে দ্রুত এ মহামারির অবসান হয়। চেষ্টা করতে হবে এ জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকার। ইতিপূর্বে যত মানব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাতে নির্দিষ্টএকটা শ্রেণির অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু চলমান অদৃশ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। এ জীবনযুুদ্ধে বাদ পড়েনি শিশু,যুবক,বৃদ্ধা কেউ। সমাজের নর-নারী থেকে শুরু করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও সমান্তরাল এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে।
চলমান এ যুদ্ধে কোন শ্রেণির মানুষ কতটা ত্যাগ স্বীকার করছে তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। চোখের গহ্বরের অশ্রুকে আবদ্ধ রেখে বলতে হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। এই ভালো থাকার সব গল্প এক নয়। কেউ কোটি টাকা ব্যাংকে মজুদ রেখে বলছে আফসোস! ভালো ন্ইে। কেউ দুদিনের খাবার মজুদ রেখে ভরসার ভালো থাকা আবার কেউ খাদ্যের খুঁজে বের হয়ে হতাশার ভালো থাকা। নিন্মবিত্তরা চেয়ে আছে উচ্চবিত্তর দিকে আর উচ্চবিত্তরা সাধ্য অনুযায়ী দান করে যাচ্ছে। ঠিক এ সময়ে খুব জানতে ইচ্ছে করছে কেমন আছে মধ্যবিত্তরা?
যাদের কাছে কখনো অভাবের কথা শুনিনি তারাই মধ্যবিত্ত। যাদের মুখে কখনো আলহামদুলিল্লাহ ছাড়া কোন আওয়াজ বের হয়নি তারাই মধ্যবিত্ত। যাদের মুখ থেকে কখনো হাসি ফুরায়নি তারাই মধ্যবিত্ত। যারা কখনো কারো কাছে মাথা নত করেনি তারাই মধ্যবিত্ত। যারা সারাদিন ভালো থাকার অভিনয় করে যায় তারাই মধ্যবিত্ত। আজ কেমন আছে সে সব বাবারা যাদের অভিনয়ের পর্দা উন্মেচিত হয়ে গেছে। অনিশ্চিত এক সম্ভাবনা নিয়ে সময় কাঁটছে প্রতিটি পরিবারের।
আমাদের দেশে মধ্যবিত্তরা আসলে কারা?
উচ্চবিত্ত: কল-কারখানার মালিক,উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, এমপি-মন্ত্রী,ধনী ব্যবসায়ী প্রভৃতি এ শ্রেণিভুক্ত। তবে এ করোনা যুদ্ধকালে বলা যায় যাদের কাছে সর্বনিন্ম এক বছরের খাবার মজুদ আছে। কোন মহামারী এতদিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সুতরাং আসুন সাধ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ এ সংকট মোকাবেলায় অসহায়দের পাশে দাঁড়াই। মনে রাখা জরুরি মধ্যবিত্ত এবং নিন্মবিত্ত ছাড়া কিন্তু উচ্চবিত্তের কোন দাম নেই এবং তাদের ছাড়া টিকে থাকাও সম্ভব না।
মধ্যবিত্ত: শিক্ষক,চিকিৎসক,প্রকৌশলীসহ পেশাজীবি শ্রেণি মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্ন্তুভুক্ত। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আবার উচ্চ-মধ্যবিত্ত,মধ্যবিত্ত ও নিন্ম মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এ সময়ে এদের কাছে সর্বনিন্ম এক মাসের খাবার মজুদ আছে। সুতরাং চলমান সংকট্ যেহেতু একমাসের বেশি অবস্থান করছে তাই উচ্চবিত্তরা নিন্মবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের দিকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন।
নিন্মবিত্ত: কৃষক, শ্রমিক, কর্মজীবি,দিনমজুর প্রভৃতি অবস্থানের মানুষ এ শ্রেণির অধিভুক্ত। এদের কাছে সর্বনিন্ম একদিনের খাবার মজুদ থাকে। যাদের দিন আনে দিন খায় বলা যায়। চলমান সংকটে এদের অবস্থা করুন হলেও সরকার থেকে শুরু করে সহযোগি সংগঠন সবাই সহযোগিতা করছে।
এ তিনশ্রেণির বাহিরেও আরেকটি শ্রেণি আছে যাদের কোন বিত্ত বা ভিত্তি কিছুই নেই। ভিক্ষুক,পথশিশু,টোকাইসহ এ শ্রেণির অর্ন্তুভুক্ত। রাস্তাই যাদের আশ্রয়স্থল। এদের কাছে কোন খাবার মজুদ থাকে না। যখন যা পায় তাই খায়।
আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হল মধ্যবিত্ত শ্রেণি। আসুন তাদের নিজের মুখেই শুনি কেমন আছে মধ্যবিত্তরা।
১. গত চল্লিশবছর যাবৎ সংসার চালাই কিন্তু কখনো ভিতরের অবস্থাটা কাউকে বুঝতে দেইনা। কিন্তু এখন কাছের লোকদের কাছে নিজের মুখোশটা খুলে গেল ।
২. যেভাবেই হোক সংসারটা চালানোর ব্যবস্থা করি কিন্তু সামনে ঈদ। মার্কেট বন্ধ থাকলে বাচ্চাদের বোঝানো যেত কিন্তু এখন কি করবো আর কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
৩. অভাবের তাড়নায় মাঝে মাঝে মন চায় আত্মহত্যা করি কিন্তু তাতেতো আর সংকট কাটবে না বরং আরো প্রকোট হবে।
৪. আর পারছি না। কারো কাছে কিছু চাইতেও পারছি না। মুখ খুলে কিছু বলতেও পারছি না। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না।
৫. ঘরে খাবার নেই। গত একমাস যাবৎ বিভিন্ন লোকদের কাছে ঋণ করে চলতেছি কিন্তু এখন আর কেহ ঋন দিতে চায় না। সামনে হতাশা কি করবো আল্লাই ভালো জানেন।
৬. ঋনকরে সংসার কোন রকম চালাচ্ছি কাউকে কিছু বুঝতে দিচ্ছি না। কিন্তু গত কয়েকদিন ছেলেটা অসুস্থ ঔষধ কেনার টাকাও নাই। কারো কাছে ঋনও পাচ্ছি না। গাড়ির নিচে মাথা দিয়ে মরতে মন চাচ্ছে।
৭. ছোটখাট একটা প্রাইভেট চাকুরি করতাম। করোনার কারনে বন্ধ। গতমাস থেকে বেতন বন্ধ। শাক-লতা খেয়ে জীবন চালাচ্ছি। ঋন করে এক বস্তা চাল কিনেছিলাম। তাও প্রায় শেষ পর্যায়। সামনে কি হবে আল্লাহই ভালো জানেন।
৮. মেয়েটাকে নতুন বিয়ে দিয়েছি। জামাই বাড়িতে আসার পর লকডাউন হয়ে গেছে। আর যেতে পারেনি। নিজেরাতো না খেয়ে থাকতে পারতাম। কিন্তু জামাইকেতো আর না খেয়ে রাখা যায় না। কারো কাছে হাতও পাততে পারি না। চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না।
৯. স্বল্প বেতনে ছোট একটা চাকুরি করতাম। মার্চের শুরতে বিয়ে করেছি। বেতন বন্ধ দুই মাস। নতুন বউয়ের সামনে আসল চেহারাটা উন্মেচিত হয়ে গেছ। মসজিদে গিয়ে গোপনে কান্না কর্ িযাতে আল্লাহ দ্রুত এ মহামারি উঠিয়ে নেন।
১০. সবাই জানতো খুব ভালো আছি কখনো কাউকে কিছু বুঝতে দেইনি। কিন্তু চলমান সংকটে সবার সামনে চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে গেল। সংসারে মাছ কবে কিনেছি মনে নেই। ডাল-ভাত-ভর্তা আর কত খাওয়া যায়।
১১. ঘরে চারজন ছেলে-মেয়ে। আয় রুজি বন্ধ গত দু-মাস। একমাস কোন রকম চালিয়েছি কিন্তু এখন আমি আর আমার স্ত্রী না খেয়ে থাকছি। সন্তানদের বলছি আমরা পরে খাব তোমরা খাও। কিন্তু বড় মেয়েটা সব বুঝে গেছে। সারাদিন শুধু কান্না করে।
১২. ঘরে ছোট একটা ছেলে আছে তাকে আলগা দুধ খাওয়াতে হয়। নিজেরা না খেয়ে থাকলে সইতে পারি কিন্তু বাচ্চা মানুষ গত দুইদিন ঘরে দুধ নাই। কিনার টাকাও নাই। কারো কাছে ঋনও পাচ্ছি না। ছেলেটা সারাদিন কান্না করে। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
১৩. একটা প্রতিষ্ঠানে পাঁচ হাজার টাকা বেতনে চাকুরি করতাম। গত দুইমাস বন্ধ। বেতনও বন্ধ। আত্মমর্যাদার কারনে কাউকে কিছু বলিনা। না খেয়ে মরে গেলেও কারো কাছে হাত পাতবো না।
১৪. গ্রামের মসজিদের মুয়াজ্জিন। প্রতিমাসে এমনেই বেতন বাকি থাকে। মসজিদ বন্ধ থাকায় কোন কালেকশান নাই। তাই বেতনও বন্ধ। নিজের খাবারতো চলছে কিন্তু গত দুইমাস সংসারে একটাকাও দিতে পারিনি। কিভাবে কি করছে আল্লাই ভালো জানেন।
১৫. গত ছয়মাস চাকুরি ছিল না। মার্চ মাসে একটা চাকুরিতে যোগদান করি। কিন্তু মাঝখানে বন্ধ হওয়াতে বেতন আর পাইনি। ঘরে বউ বাচ্চা কিভাবে কি হবে জানিনা।
এগুলো আমার কথা নয়। মধ্যবিত্ত কিছু সংসার পরিচালকের কথা। এখানেতো সীমিত কিছু কথা। কিন্তু আমার জানামতে আরো অনেক অনেক কষ্টে জীবন কাটানো মানুষ আছে। তাই আসুন, এ যুদ্ধে সবাই সবাইকে সহযোগিতা করি। আর আল্লাহ পাকের কাছে নিজের গোনাহের কথা স্মরণ করে রহমত ও ক্ষমা চাই। আল্লাহ তায়ালা যাতে খুব দ্রুত এ গজব থেকে আমাদের হেফাযত করেন। আমিন।


source https://deshdunianews.com/%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%95%e0%a6%9f%e0%a7%87-%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%ae%e0%a6%a8-%e0%a6%86%e0%a6%9b%e0%a7%87-%e0%a6%ae%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af/

0 Comments