মুফতি সালাহুদ্দীন আইয়ুবী
ইয়ামিনউদ্দৌলা আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে সবুক্তগিন ৷ সাধারণভাবে মাহমুদ গজনভী, সুলতান মাহমুদ গজনভী নামে পরিচিত ৷ ছিলেন গজনভী সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাসক। ৯৯৭ থেকে ১০৩০ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পূর্ব ইরানীয় ভূমি এবং ভারত উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অংশ (বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) জয় করেন। সুলতান মাহমুদ সাবেক প্রাদেশিক রাজধানী গজনীকে এক বৃহৎ সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধশালী রাজধানীতে পরিণত করেন। তার সাম্রাজ্য বর্তমান আফগানিস্তান, পূর্ব ইরান ও পাকিস্তানের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল।(উইকিপিডিয়া)
তিনি অত্যন্ত উদার ও ন্যায়পরায়ণ সুলতান ছিলেন৷ পাশাপাশি একজন বিচক্ষণ,দূরদর্শী ও সাহসী যোদ্ধা ছিলেন ৷ স্বীয় পিতা সুবক্তগীন এর মৃত্যুর পর খেলাফতের পদে অধিষ্ঠিত হন এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন ৷
তিনি ১০০০ -১০২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ১৭ বার ভারতে সেনা অভিযান পরিচালনা করেন ৷ তার ১৭ বার ভারত আক্রমণের পিছনে ভারতীয় রাজাগণ কর্তৃক সন্ধি-চুক্তি ভঙ্গ, তার আনুগত্য অস্বীকার এবং ভারতীয় মিত্রকে উৎপীড়ন প্রভৃতি ছিল অনিবার্য কারণ ৷
সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রোমণের ইতিহাসে সোমনাথ মন্দির অভিযান উল্লেখযোগ্য ঘটনা ৷ ১০২৬ খ্রিস্টাব্দে ৬ জানুয়ারি তিনি সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণ করেন ৷ হিন্দুরা প্রবল বাধা প্রদান করেও অবশেষে পরাজিত হয় ৷
সোমনাথকে কেন্দ্র করে আধুনিক ইতিহাসে মাহমুদ গজনভীর মত স্বচ্ছ-চরিত্রবান একজন মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানের উপর ভারতের মন্দিরসমূহ ধ্বংস করে ইসলাম প্রচার করা, অর্থ লুণ্ঠন করাসহ অসংখ্য অপবাদ আরোপ করা হয় ৷ অথচ প্রকৃত ইতিহাস এসমস্ত ধারনার একটিও সত্য বলে প্রমাণ করে না৷ তার ভারত আক্রমণ ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাপার ৷ তদানীন্তন সময়ে ভারতের ধন-সম্পদ এমনকি জলদস্যু কতৃক লুন্ঠিত সম্পদসমূহও সোমনাথ মন্দিরে গচ্ছিত রাখা হত ৷ এসব কারণে সোমনাথ মন্দির তখন মন্দির হয়েও রাজনৈতিক আখড়ায় পরিণত হয়েছিল ৷ আর এই দৃষ্টিকোণ থেকেই সুলতান মাহমুদ গজনভী সেখানে অভিযান পরিচালনা করেন ৷
ডক্টর ঈশ্বরী প্রসাদ এই কথার সমর্থনে বলেন, মাহমুদ গজনভী ভারতের যে মন্দির গুলো আক্রমণ করেছিলেন সেগুলো বিপুল ও বর্ণনাতীত ধনরত্নে পূর্ণ ছিল এবং সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি ছিল রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রস্থল (mediaeval inddia: 191)
অতএব একথা স্পষ্ট হয়ে গেল ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণেই তিনি মন্দির ধ্বংস ও লুন্ঠন করেছিলেন এ কথা আদৌ সত্য নয় ৷
সুলতান মাহমুদ হিন্দুদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতেন ৷ তিনি হিন্দুদের বিচার হিন্দু আইন অনুযায়ী করতেন ৷ এমনকিএ নিয়মে ভারতীয় সংবিধান চলত ৷ যদিও এর প্রমাণ তারিখে বাইহাকির মতো গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে (৬১৩, ৭৫৬) তবুও বাংলা অনুবাদক ও লেখকদের এ বিষয়টি লিখতে মনে থাকেনা ৷ বাস্তবতা হলো সুলতান মাহমুদ ছিলেন একজন নামাযী, পরহেজগার ও দাড়িওয়ালা নিষ্ঠাবান মুসলমান ৷ এটাই অনেকের কাছে তার বিরাট অপরাধ ৷ তৎকালীন যুগের মুসলমানরা তাকে গাজী ও ইসলামী নেতা বলে জানতেন ৷
হিন্দুরা অনেকেই আজ পর্যন্ত তাকে নিষ্ঠুর, অত্যাচারী, মূর্তিভঙ্গ কারী বলে মনে করে থাকেন ৷ কিন্তু যারা সে যুগের ইতিহাস জানেন তারা ভিন্ন মত পোষণ করতে বাধ্য ৷ নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের চোখে মাহমুদ গজনবী একজন শ্রেষ্ঠ জননেতা ৷ ন্যায়পরায়ন সুলতান ৷ সাহসী, প্রভাবশালী সেনাপতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার উৎসাহদাতা ছিলেন ৷
সবশেষ আর একজন হিন্দু ঐতিহাসিকের মূল্যবান উদ্ধৃতি দিয়ে প্রসঙ্গ শেষ করতে চাই ৷ ঐতিহাসিক শ্রী সুরজিৎ দাশগুপ্ত তাঁর “ভারতবর্ষ ও ইসলাম ” বইয়ের ৩১ নং পৃষ্ঠায় লেখেনঃ “এটাই সঠিক কথা যে মাহমুদ গজনবীর যে সমর প্রতিভা ছিল তার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ৷ প্রাকমুসলিম ভারতীয় রাজাদের দ্বারা প্ররোচিত না হলেও মাহমুদের সমরপ্রতিভা কোন না কোন ভাবে প্রকাশিত হত ৷ হয়তো সে ক্ষেত্রে তার পক্ষে ভারতবর্ষের পরিবর্তে চীন তথা পূর্ব দিকে আক্রমণ চালানো সম্ভব ছিল ৷ কিন্তু ভারতীয় রাজান্যদের স্পর্ধা, শঠতা ও সন্ধি ভঙ্গের অপরাধ তার প্রতিভাকে বিশেষভাবে ভারতবর্ষের দিকে বিকাশের অনুকূল পরিবেশ করে দিয়েছিল৷ পাঞ্জাব ছাড়া ভারতীয় ভূখণ্ডে কোথায় রাজত্ব প্রতিষ্ঠা অথবা ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে ধর্মপ্রচারে পরিকল্পনা তাঁর ছিল না৷”
উল্লেখ্য, কয়েকদিন পূর্বে সুলতান মাহমুদ গজনবীর সমকালিন বিজ্ঞানী আল বিরুনী জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ থেকে আল বিরুনীর জীবনী প্রকাশ করা হয় ৷ প্রসঙ্গ ক্রমে সেখানে সুলতান মাহমুদ গজনবী কিছু বিকৃত ইতিহাস পরিলক্ষিত হয় বিশেষত রোয়ার বাংলা পোর্টালে ৷ বক্ষ্যমাণ এই প্রবন্ধে আমরা সেই অভিযোগের উত্তর হিসেবে সত্য ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি ৷
(তথ্যসূত্রঃ চেপে রাখা ইতিহাস ও অন্যান্য)
লেখক: সিনিয়র উস্তাদ, দারুল উলুম মহিউসসুন্নাহ নুরপুর মাদ্রাসা ৷
source https://deshdunianews.com/%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%a6-%e0%a6%97%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a6%ad%e0%a7%80-%e0%a6%90%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9/
0 Comments