আসুন আত্মসমালোচনা করি, ইসলামপ্রিয় জনগণের আবেগ-ভালোবাসা কাজে লাগাই

আমাদের মাঝে একটা তুমুল বিতর্কের প্রসঙ্গ হলো ‘ইসলামের শত্রু’। কারো বক্তব্য বা কর্মনীতি আমাদের কাছে বেমোয়াফেক মনে হলেই এই তকমাটি অবধারিতভাবে আমরা ব্যবহার করতে খুব পছন্দ করি। তবে এগুলো যতটা না তাকে ইসলামবিরোধী সাব্যস্ত করার উদ্দেশ্যে হয়, তারচেয়ে বেশি হয় ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রশমনের জায়গা থেকে।
আমার প্রায়শই মনে হয়, এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। আরো পরিষ্কার করে বললে এদেশের আলেম সমাজের দায়টা মনে হয় এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। অনেকে ভাবছেন আমি আলেম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছি, আল্লাহ মাফ করুন, রক্ষা করুন।
এদেশে ইসলামের যতটুকু আলো এখনো দেদীপ্যমান হয়ে জ্বলছে আমি হলফ করে বলতে পারি- তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পুরোটা অবদানই আলেম সমাজের। তারপরও আল্লাহ তাআলা যেহেতু জাতির নেতৃত্বের জন্য তাঁদেরকেই নির্বাচন করেছেন, অতএব নেতৃত্বের ছড়িটা হাতে নেওয়া এবং এই অচলায়তন সমাজব্যবস্থার আগল ভেঙ্গে নতুন করে ঢেলে সাজানোর দায়িত্ব তো তাদেরকেই নিতে হবে। হ্যাঁ, এ পথ মোটেও ফুলবিছানো পথ নয়, এখানে আছে ক্ষুধা-দারিদ্র, অসম লড়াইয়ে নামার আহ্বান। আল্লাহ তায়ালা হুকুম, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ও সাহাবাদের যাপিত জীবনকে সামনে রেখেই ইসলাম প্রতিষ্ঠায় এগুলো জয় করতে হবে।
কেউ কেউ বলতে পারেন, জনগণ তো ইসলাম চায় না, ইসলামপন্থীদেরকে ভোট দেয় না । মুখে বলে হুজুর হুজুর, ভোট দেওয়ার সময় নৌকা আর ধানের শীষ…।
না ভাই, আমি এ কথা মানতে পারছি না। আমরা কি জনগণের সামনে জনবান্ধব রাজনৈতিক কোনো চিন্তাধারা পেশ করতে পেরেছি যে, তারা রাষ্ট্র চালানোর মতো দায়িত্বের জন্য আমাদেরকে ভাবতে পারবে? ‘রহমত’ সম্পাদক মনযূর আহমাদ সাহেব বলেছিলেন- “এদেশের ইসলামি দলগুলোর বক্তব্য শুনলে মনে হয় ওয়াজ-নসিহত শুনছি, সেখানে রাজনীতি কোথায়?”
মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, আবাসন, পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থাপনা নিয়ে যেন কোনো দায়িত্ব বা ভাবনা আমাদের নেই। বলুন, জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের উপর আস্থা রাখবে কোন দুঃখে!
আমরা কি ভেবে দেখেছি, এদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় এখনো ইসলামটাই সত্য  ভালোবাসার যত্নে লালিত হয়ে আছে?
আমি কয়েকটি উদাহরণ দিই;
২০০১ সালে আমেরিকা যখন আফগানিস্তানে আক্রমণ করল তখন এদেশে সংসদ নির্বাচনের উৎসব চলছে। আমার মনে আছে, তখন সেই উৎসব ছাপিয়ে সারা দেশের মানুষের কাছে আলোচনার বিষয হয়ে দাঁড়িয়েছে আফগানিস্তান, মোল্লা উমর আর উসামা বিন লাদেন।বাংলাদেশের মানুষের কাছে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া নন, হিরো হয়ে উঠেছিলেন উসামা বিন লাদেন আর তালেবানরা। নির্বাচনী মিছিলগুলো পর্য ন্ত আমেরিকাবিরোধী মিছিলে পরিণত হচ্ছিল। পরে শুনেছি, সেসময় আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদ সাহেব নাকি পাবলিক মুভমেন্ট বুঝে ভোলায় তার নির্বাচনী জনসভায় বলেছিলেন- “আজকে আমার দুর্ভাগ্য, আমাকে এখন নির্বাচন করতে হচ্ছে, নইলে আমি এখন থাকতাম আফগানিস্তানের রণাঙ্গনে, মার্কি ন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ইসলামের পক্ষে যুদ্ধ করতাম ।” শ্রোতারাও তার বক্তব্য শুনে আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার জয়ধ্বনি দিয়ে উঠেছিলেন।
২০০৩ সালে মার্কিন বিরোধী একটি মিছিলে অংশ নেওয়ার জন্য মগবাজার থেকে বায়তুল মুকাররম গেলাম। উদ্দেশ্য পরিচিত কিছু ছাত্র ভাইদের নিয়ে হলেও একটা প্রতিবাদ মিছিল করব। সেখানে গিয়ে দেখলাম শত বা হাজার নয়, লাখ লাখ উত্তেজিত মানুষ বিক্ষোভে যেন আক্ষরিক অর্থেই ফেটে পড়ছে। না, মাদরাসার ছাত্ররা না, একেবারেই সাধারণ মানুষ। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ মানুষ এলকোর অফিস, লিভার ব্রাদার্সের বিলবোর্ডসহ সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থের যোগানদাতাদের যা সামনে পেয়েছে ভেঙ্গেচুরে পায়ের নিচে ফেলে দিচ্ছে।
অনেকক্ষণ ধরে দু চোখ ঝাপসা হয়ে থাকা এই আমি রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছি । চোখের পানি কোনো বাধাই যেন মানছিল না, শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম- মালিক, এই দেশের মানুষ ইসলামকে এত ভালোবাসে!
২০১৩ সালে কাছ থেকে দেখেছি, হেফাজতের ডাকে আল্লাহ, আল্লাহর রসুল অবমাননার আগুনে পোড়া এদেশের মানুষের জানবাজি রেখে শাপলা চত্বরের বিস্ফোরণ। ভালোবাসার মহার্ঘ আসনে ইসলামই যে একমাত্র আসীন তা মানুষ আবারো ভালো করে বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছে।
সবশেষ হজরত আনসারি হুজুরের জানাজা। লকডাউনের এই সময়ে নরসিংদী, হবিগঞ্জ আর বি. বাড়ীয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তাদেরকে পায়ে হেঁটে, ঝক্কি-ঝামেলা সয়ে কে আসতে বলেছে ? কিসের টানে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে লাখো মানুষের এই জমায়েত তৈরি হলো ? মানুষ কি এতোই বোকা!
ভাই, এরপরও কি আমরা বলব জনগণ ইসলামের পক্ষে নেই।
এই পবিত্র ভালোবাসা-আবেগগুলো যে কত বড় শক্তি! আমরা যদি এই শক্তিগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করে কাজে লাগাতে পারি তাহলে ইসলামের পতাকা বিজয়ী হাসিতে উড্ডীন হওয়া কি সময়ের ব্যাপার নয় ?
আসুন আমরা আত্মসমালোচনায় এগিয়ে আসি। কেন আমাদেরকে তারা করুণার পাত্র ভাববে, কেন আমরা আমাদের ‍রুটি-রুজির জন্য আত্মমর্যাদা বিলীণ করে তাদের দুয়ারে হাত পেতে পেতে বিকৃত প্রসাদ লাভ করব!
নতুন করে আবার ভাবি, বুঝতে চেষ্টা করি, আকাবিরদের ভালোভাবে অধ্যয়ন করি। কারণ তারা উত্তমরূপেই তাদের কাজ করে দেখিয়ে গেছেন। আল্লাহ আমাদের সহি সমঝ দান করুন। আমিন।
মুফতি মুহিউদ্দিন আহমাদ মাসুম
শিক্ষাসচিব, আয়েশা সিদ্দিকা মাদরাসা, কুমিল্লা।


source https://deshdunianews.com/%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a7%9f-%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a6%97%e0%a6%a3%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%86%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%97-%e0%a6%ad/

0 Comments