দেশ দুনিয়া নিউজ
সংগঠন অভিজ্ঞতা ও কর্মপন্থা-পর্ব ২, শেখ ফজলুল করীম মারুফ
পড়ুন আগের পর্ব: সংগঠন অভিজ্ঞতা ও কর্মপন্থা- পর্ব ১
“প্রতিনিয়ত চিন্তা, পুনঃচিন্তা ও প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তা”
ٱلَّذِينَ يَذْكُرُونَ ٱللَّهَ قِيَٰمًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِى خَلْقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَٰطِلًا سُبْحَٰنَكَ فَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ
যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও।
সূরা আল ইমরানঃ১৯১
এছাড়াও আল কোরআনের বহু আয়াতে চিন্তা করার ব্যাপারে গুরুত্ত্বারোপ করা হয়েছে।
বস্তুতঃ মানুষ সৃষ্টি সেরা হওয়ার একমাত্র কারণ মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা। মানুষ প্রতিনিয়ত চিন্তা করেও। এবং সেজন্যই মানব সমাজ এতো বেশী বৈচিত্র্যময়।
সমাজে যতজন মানুষ ঠিক ততটাই বৈচিত্রময় একেকটা সমাজ। এই বৈচিত্র্যময় সমাজকে নেতৃত্ব দিতে হলে যেকোন সংগঠনকে অতিমাত্রায় চিন্তাশীল হওয়া বাধ্যতামূলক। সংগঠনের চিন্তাশীলতা সমাজের সম্মিলিত চিন্তা ও বৈচিত্র্যকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। তবেই সেই সংগঠন সমাজকে নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করবে।
ইসলাম চরিত্রগতভাবে চিন্তাকে উৎসাহিত করে। সেজন্য একেবারেই গুটিকতক বিষয় ছাড়া সমস্ত বিধিবিধানকেই ইসলাম ইজতেহাদ তথা চিন্তা-গবেষণার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। নামাজের মতো প্রধান ইবাদতের বহু মাসয়ালাকেও ইজতেহাদের বিষয় বানিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোকে কিছু নীতিমালার অধিনে পুরোটাই চিন্তা-গবেষণার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ইসলাম চিন্তা-গবেষণাকে এতোটা উৎসাহিত করে যে, এখানে চিন্তা করে ভুল করলেও পুরুস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
সেজন্যই ইসলামের প্রথম শতাব্দিগুলোতে এতো এতো গবেষক ও চিন্তকের আবির্ভাব হয়েছিলো। এবং সেইসব গবেষক ও চিন্তক মাত্র শতাব্দিকালের মধ্যেই পুর্বের কোন উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞানভিত্তি ছাড়াই ইসলামী সভ্যতাকে বিশ্বের সেরা সভ্যতায় পরিনত করে ফেলেছিলো। যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্ব শাসন করেছে। এই শাসনের ভিত্তি পশ্চিমাদের মতো ষড়যন্ত্র, অপকৌশল ও সহিংসতা ছিলো না বরং উন্নত চিন্তা-চেতনা ও জ্ঞান দিয়েই তারা বিশ্ব শাসন করেছে।
ইসলামী চিন্তা জগত একই সাথে নতুন চিন্তা ও প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তাকেও উৎসাহিত করে। ইসলামী বিশ্বের সবচেয়ে বড়, বিস্তৃত ও সুসংগঠিত মাজহাব হানাফি মাজহাবের আইম্মায়ে সালাছা তথা শীর্ষ তিন ইমামের মধ্যকার মতোবিরোধের মাত্রা ও পরিমান দেখলেই তা অনুমান করা যায়।
ইসলাম যে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী, অপ্রতিরোধ্য ও দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম তার প্রধান কারণও ইসলামের এই চিন্তা, পুনঃচিন্তা ও প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তা করার বৈশিষ্ট্য। এবং গত এক শতাব্দীকাল ধরে ইসলাম যে পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি এবং গত দুই-তিন শতাব্দী ধরে জ্ঞানগতভাবে ও মানসিকভাবে পরাজিত হয়ে আছে তার কারণও এই চিন্তা, পুনঃচিন্তা ও প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তা করার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলা।
দুঃখজনক সত্য হলো, গৌরবময় শতাব্দীগুলোর পরে ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী এইদিকটাকে রাসুল সঃ ঘোষিত ইসলামী জ্ঞানের উত্তরাধিকারীগনই নষ্ট করেছেন। তারা নানাভাবে ইজতেহাদকে নিরুৎসাহিত করেছেন এবং মতোবিরোধকে শক্তভাষায় আক্রমন করেছেন। মতোভিন্নতা পোষনকারীদের নির্মমভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফলে নতুন কোন মুজতাহিদ তৈরী হয়নি। দ্রুত পরিবর্তনশীল সভ্যতার সাথে মুসলিমবিশ্ব তার মেলাতে পারেনি।
কি দুঃখজনক বাস্তবতা! ইবনে খালদুন, ইবনে সিনা, ফারাবি, কিন্দি, গাজ্জালী, তাইমিয়াসহ শত শত কালজয়ী মনিষা জন্ম দেয়া একটি প্রাজ্ঞ ও পরিনত সভ্যতা পরবর্তীতে নিউটন, পাস্তুর, হেগেল, ফয়েরবাখ, মার্ক্স, ফুকো, দারিদা, স্মিত ইত্যাদির সমকক্ষ তৈরী করতে পারছে না।
কি হতাশাজনক সত্য যে, চৌদ্দশত বছর বিশ্ব শাসন করা একটি সভ্যতা ১৯ শতকের শুরুতে এসে এতোটাই বাজে পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো যে, পশ্চিমা পুজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মোকাবিলায় কোন বয়ান দাড় করাতে পারছিলো না। এই দুই পশ্চিমা বস্তুবাদী মতবাদের মোকাবিলায় ইসলামের রাজনৈতিক দিক ফুটিয়ে তুলতে পারছিলো না। ফলে পুজিবাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে মাওলানা হাসরত মোহানী, আজাদ সুবহানী ও মাওলানা ভাসানী, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্দিকে সমাজতন্ত্রের আশ্রয় নিতে হয়েছিলো।
কি ভয়ংকর কথা যে, চৌদ্দশত বছরে শত শত সাম্রাজ্যের জন্ম দাতা একটি সভ্যতা ২য় বিশ্বযুদ্ধত্তোর বিশ্বের গতিপথ নির্ধারনে ভূমিকা তো রাখতেই পারে নি এমনকি জাতিরাষ্ট্রে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের পদ্ধতি কি হবে সেটাই জানতো না।
চিন্তা, পুনঃচিন্তা ও প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তা বা ইজতেহাদকে রুদ্ধ করে ইসলামী বিশ্ব এতোটাই স্থবির ও অন্ধ অনুকরণশীল হয়ে পড়েছে যে, তারা পশ্চিমের বস্তাপঁচা সব চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতিকে সাগ্রহে গ্রহণ করে নিচ্ছে।
এই করুণ ও বিপর্যস্ত অবস্থাতেও ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইসলামী সংগঠনগুলো ইসলামের সেই জাদুর কাঠি চিন্তা, পুনঃচিন্তা ও প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তাকে বা ইজতেহাদকে পুরনায় উৎসাহিত করে নাই। বরং ইসলামের কিছু নির্দেশনার ভুল ব্যাখ্যা করে নিজেদের গোঁড়ামির ওপরে অটল থেকেছে।
পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ হয়ে পড়েছে যে, ২য় বিশ্বযুদ্ধত্তোর বিশ্বের শীর্ষ দার্শনিক সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রঃ তার “ইসলামের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ” গ্রন্থে আক্ষেপ করে লিখেছেন, চিন্তা ও পরিবর্তনকামী অনেক দলও নিজেরাই আবার নিজেদের চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং নতুন চিন্তা, পুনঃচিন্তা ও প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তার পথ রুদ্ধ করে দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন গ্রহণ করেছিলো সেই কালজয়ী নীতি,
“প্রতিনিয়ত চিন্তা, পুনঃচিন্তা ও প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তা”।
ছাত্র রাজনীতির উদ্দেশ্য কি?
“ছাত্ররাজনীতি” এর কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নাই। এবং এর বিশ্বজনীন কোন ধরনও নাই। আমাদের বাংলাদেশে যেধরনের ছাত্ররাজনীতি হয় সেধরনের ছাত্র রাজনীতি বিশ্বের অন্য কোথাও হয় না।
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিকে মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়।
১. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলীয় স্বার্থ রক্ষা ও ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিকে দমন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করে রাজনীতি।
২. কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে সেই আদর্শের চেতনা জাগ্রত করা এবং আগামী আদর্শিক বিপ্লবের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষন দিয়ে বিপ্লবের জন্য নেতৃত্ব তৈরী করা। এটা আদতে রাজনীতি না বরং আদর্শিক সংগ্রাম।
ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন ২য় ধারার ছাত্র সংগঠন। সেকারনেই ইশা ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রমকে ছাত্র রাজনীতি বলা যায় না। বরং আমরা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আদর্শিক দাওয়াতী কার্যক্রম ও গঠনমুলক পরিবর্তনের জন্য কাজ করছি।
আমরা সংগঠনের মাধ্যমে চার ধরনের কাজ করি।
১. দক্ষতার উন্নয়ন
২.নৈতিকতার উন্নয়ন
৩. দেশত্ববোধ তৈরী
৪.ইসলামের সামগ্রিক চেতনা লালন ও বাস্তবায়ন।
আমরা মনে করি, এগুলোই যে কোন ছাত্র সংগঠনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ।
লেখক: শেখ ফজলুল করীম মারুফ
সাবেক, কেন্দ্রীয় সভাপতি; ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন
সংগঠন অভিজ্ঞতা ও কর্মপন্থা-পর্ব ২, শেখ ফজলুল করীম মারুফ
deshdunianews
source https://deshdunianews.com/%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%97%e0%a6%a0%e0%a6%a8-%e0%a6%85%e0%a6%ad%e0%a6%bf%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%9e%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%93-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%aa%e0%a6%a8%e0%a7%8d-2/
0 Comments