দেশ দুনিয়া নিউজ
বিশেষ প্রতিবেদন: লকডাউনে কর্মহীন খেটে খাওয়া মানুষদের দুঃখের কথা
নিজাম উদ্দীন আলগাজী: সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে সারা কঠোর খাটুনি খেটে কাজ শেষে উপার্জিত অর্থ দিয়ে পরিবারের যতসামান্য নিত্যপ্রয়োজন মেটানো। পরের দিন আবার কাজের সন্ধানে বের হওয়া। এই জীবনচক্রের মধ্যে থাকা শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা দেশে প্রায় ২ কোটি; যাদের নেই কোনো সঞ্চয়। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস লকডাউনে প্রথম আঘাত খেটে খাওয়া এ দরিদ্র মানুষগুলোর উপরই এসেছে। কয়েক দিন ধরে কর্মহীন জীবন পার করছেন নিম্ন আয়ের এসব মানুষ।
করোনাভাইরাসের ঝুকি এড়াতে সরকার ২৬ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করেছে। সকল প্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছুটি চলছে। বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষ। সবকিছু থমকে থাকায় কাজে বের হতে পারছেন না কুলি-মুটে, নির্মাণ ও আবাসন শ্রমিকসহ সব ধরনের দিনমজুর। দেশে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত। এ খাতের বড় অংশই দৈনিক, চুক্তিভিত্তিক মজুরি এবং নিয়োগপত্র ছাড়াই কাজ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্রমিক কাজ করছেন মুদি কিংবা বিভিন্ন দোকানে। এর পাশাপাশি পরিবহন, বন্দর, নির্মাণ ও আবাসন এবং হাটবাজার শ্রমিক রয়েছেন। সব মিলিয়ে দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কাজ করেন প্রায় দুই কোটি শ্রমিক, যারা এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
পত্রিকার পাতা থেকে লকডাউনে কর্মহীন খেটে খাওয়া মানুষগুলোর দুঃখের কথা একটু শুনুনঃ
(১) করোনা দিনমজুরকে বানাল পকেটমার (প্রথম আলা)
আয়–রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছিলেন না। অবশেষে ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়েন। স্থানীয় লোকজন তাঁকে গণপিটুনি দেয়। মঙ্গলবার সকালে নাটোরের গুরুদাসপুর পৌর শহরের চাঁচকৈড় মাছবাজারে এ ঘটনা ঘটেছে।
(২) “করোনা নয় এখন ছেলে-মেয়ে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে” (চাদপুর টাইমস)
রিক্সাচালক জামাল হোসেন বলেন,‘পেটের দায়ে রিক্সা নিয়ে বের হয়েছি। সকাল থেকে রিক্সা নিয়ে এখানে বসে আছি। রাস্তায় কোন যাত্রী নাই। আগে হাজার বারো’শ টাকার মত আয় করতাম এখন পর্যন্ত পঞ্চাশ টাকাও ইনকাম করতে পারিনি। আমার মত আরো আট দশজন রিক্সা নিয়ে বসে আছে। করোনা আতঙ্কে লোকজন ঘর থেকে বের হচ্ছে না। তাই আমরা আয় করতেও পারিনা। কিভাবে আমাদের সংসার চলবে।’ আক্ষেপ করে তিনি বলেন, মনে হয় করোনা নয় এখন আমাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। এই মূর্হূতে সাহায্য সহযোগিতা পেলে আমরা কিছুটা রক্ষা পাব।)
(৩) ‘না খেয়ে আছি খাবার পাঠান…’ (সমকাল)
‘স্যার ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন- আমার বাসায় কিছু চাল, ডাল, তেলসহ কিছু পাঠানো যাবে? বিকেল থেকে না খেয়ে থাকতে হবে। হাতে কোনো টাকা-পয়সাও নাই। মোবাইল ফোনে ১২ টাকা ব্যালান্স আছে।’ রাজধানীর মিরপুরের এডিসি মাহমুদা আফরোজ লাকীর সরকারি মোবাইল ফোনে এই বার্তা পাঠান। এডিসি মাহমুদা আফরোজ ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মিরপুর থানার ওসির মাধ্যমে সেই বাসায় চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ ও লবণ নিয়ে হাজির হয় পুলিশ।
(৪) `ভাইরে প্যাটের জ্বালায় ঘরে থাকন যায় না’ (দেশ রুপান্তর)
`আম্রা গরিব মানুষ, আমাগো খবর ক্যারা রাকে। দ্যাশের অবসস্থা ভালা না জানি। ভাইরে প্যাটের জ্বালায় ঘরে থাকন যায় না। কাম পাইলে কয়ডা চ্যাল নিয়া যামু।’ কথাগুলো আক্ষেপ করে বলছিলেন উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা থেকে আসা দিনমজুর মহব্বত আলী। এক সপ্তাহ ধরে কোনো কাজ না পেয়ে একবেলা খেয়ে দুবেলা না খেয়ে কাজের সন্ধানে প্রতিদিনই মির্জাপুর পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকেন মহব্বত এবং তার সঙ্গীরা।
(৫) ওসিকে দেখেই কাঁদলেন মিনারা, বললেন একবেলা খেয়ে বেঁচে আছি (বাংলাদেশ টুড়ে)
ভোলা সদর উপজেলার পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের চর আনন্দ গ্রামের এক সন্তানের জননী স্বামীহারা মিনারা বেগম (৩৫)। অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি।
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারি নির্দেশনা মেনে গত কয়েকদিন তিন বেলার পরিবর্তে এক বেলা খেয়ে জীবন ধারণ করেছিল দুটি পরিবার। খবর পেয়ে তাদের এক মাসের বাজার করে দিলেন ওসি।
(৬) অন্তত এক বেলার খাবার পৌঁছে দেন আমারে (CTG ট্রিবিউন)
, ভাইরে.. অন্তত এক বেলার খাবার পৌঁছে দেন আমারে, নয়তো না খেয়ে মরমু” – এভাবেই আকুতি জানিয়েছে লকডাউন হওয়া এক বাড়ীর বাসিন্দা।
(৮) গুলিস্তানে খাবারের জন্য ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার (রিসিং বিডি)
সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি যত গড়াচ্ছে ততই ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার বাড়ছে। এসব মানুষ খাবার না পেয়ে সীমাহীন কষ্টে দিন পার করছেন। রাতে রাজধানীর গুলিস্তানে গোলাপ শাহ মাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়ক দ্বীপ ও বিভাজকের ওপর জটলা পাকিয়ে বসে আছেন ছিন্নমূল মানুষরা। ছবি তুলতে চাইলে, এক নারী চিৎকার করে বলেন, মামা, ছবি তুলে কী হবে। পেটে তো খাবার নাই। কিছু খাবার দেন। শিউলি বলেন, কাল রাত থেকে কিছু খাইনি। ছোট তিনটা বাচ্চা নিয়ে খুব কষ্টে আছি। একজন বাবু এসে দুপুরে কিছু খাবার দিয়ে গেছেন। আমি নিতে পারিনি। মানুষের ভিড়ে ছিটকে পড়ে যাই। খাবারের জন্য বাচ্চাগুলোর কান্না সইতে পারছি না।
আরেকজন বলেন, ঘর না থাকলে ফুটপাতে ঘুমানো যায়। কিন্তু খাবার না খেয়ে তো আর থাকা যায় না। পেটের জ্বালায় মরে যাচ্ছি। পানিও পাচ্ছি না।
মাজারের পাশে গিয়ে দেখা যায়, গাদাগাদি করে বসে আছেন নারী, শিশু, বৃদ্ধরা। সামান্য খাবার নিয়ে তারা কাড়াকাড়ি করছেন। এদের মধ্যে অনেকেই সারা দিন না খেয়ে আছেন। অভুক্ত এসব মানুষদের মাঝে করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক নেই। যাকেই দেখছেন, খাবারের জন্য তার কাছেই ছুটে যাচ্ছেন। কিছু পথচারী তাদের সাহায্যও করছেন। এ সময় অপর এক নারী বলেন, খুব কঠিন সময় যাচ্ছে। আগে এরকম সময় জীবনে আসেনি। কী করে বাঁচব? কোনো খাবার কপালে জুটছে না। বড়লোকরা তো ঘরে বসে আছে। আমরা খাবার পাব কই? কাজ-কাম নাই। একটু সাহায্য পেলে আমরা বেঁচে থাকতে পারতাম। দেশে মরার ভাইরাস আসছে, আমাদের না খাইয়ে রাখছে। অন্য সময় মাজারে অনেক মানুষ আসত। তারা আমাদের সাহায্য করত। এখন তো আর কেউই আসে না। আমাদেরও খাবার জুটছে না। কবে যে আল্লাহ এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবেন, তিনিই জানেন।
(৯) ডিমলায় খাদ্য সংকটে কয়েক হাজার মানুষ (ভোরের কাগজ)
নীলফামারীর ডিমলায় করোনা ভাইরাসের কারণে অফিস-আদালত, দোকানপাট, মিনি ফ্যাক্টরি, রিকশা, ভ্যান বন্ধ থাকায় এবং সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী লোকসমাগম নিষেধ থাকায় উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে।
উপজেলা মোট জনসংখ্যার বেশির ভাগ মানুষ বিভিন্ন দোকানে মিনি ফ্যাক্টরিতে ও মাঠে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে দিন মিলে দিন খেয়ে থাকেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতে দিন মিলে দিন খাওয়া মানুষগুলো কর্মহীন হয়ে পড়ায় খেয়ে না খেয়ে ঘরে বসে অতিকষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বিশেষ করে যারা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে সংসার চালায় যেমন- ভিক্ষুক, দিনমজুর, ভ্যানগাড়িচালক, রিকশাচালক, পরিবহন শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, চায়ের দোকানদার। ইতোমধ্যে এ উপজেলায় ৫০০ পরিবারের মাঝে সরকারের দেয়া ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
(১০) খাবারের জন্য চা শ্রমিকদের বিক্ষোভ (বাংলা ট্রিবিউন)
করোনাভাইরাস ঠেকাতে সারাদেশে ঘরবন্দি মানুষ। কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংকটে পড়া শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন অনেকে। তবে এই পরিস্থিতিতে ক্ষুধার জ্বালায় শত শত চা শ্রমিক বিক্ষোভ করেছেন। ‘দুই মুঠো ভাত দে’ দাবিতে স্লোগান দিয়েছেন হবিগঞ্জের চা শ্রমিকরা। মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) সকালে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে শতাধিক চা শ্রমিক এ বিক্ষোভ করেন। দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিক্ষোভ করার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আশ্বাসে তারা ফিরে যান।
বিক্ষোভ করতে আসা চা শ্রমিক কৈলাশ মুন্ডা জানান, ‘করোনাভাইরাসে মরার আগে আমরা না খেয়েই মরে যাবো। এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেনি।’
কিছু বিত্তশালী, ইসলামী সংগঠন এগিয়ে এসেছে এসব গরীব, দুস্থ, অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে। এটা অনেক ভাল উদ্যোগ। কিছুটা হলেও অসহায়দের সহায় হচ্ছে কিন্তু তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কাজ করা প্রায় দুই কোটি শ্রমিকের শত কোটি টাকার পারিশ্রমিক আসে। সামান্য দান-সদকা, সাহায্য-সহযোগিতা তার কতটুকু পূরণ করতে পারে? বাংলাদেশ গরীব রাষ্ট্র, দীর্ঘ মেয়াদি লকডাউন যে অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব ফেলবে তা কারো অজানা নয়। তাই করোনা এসে কখন আমাদেরকে মেরে ফেলবে, এ ভয়ে আগেই আমাদের ক্ষুধা দিয়ে মাইরেন না প্লীজ..!
বিশেষ প্রতিবেদন: লকডাউনে কর্মহীন খেটে খাওয়া মানুষদের দুঃখের কথা
deshdunianews
source https://deshdunianews.com/%e0%a6%b2%e0%a6%95%e0%a6%a1%e0%a6%be%e0%a6%89%e0%a6%a8%e0%a7%87-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a7%80%e0%a6%a8-%e0%a6%96%e0%a7%87%e0%a6%9f%e0%a7%87-%e0%a6%96%e0%a6%be%e0%a6%93/
0 Comments