ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সম্পর্কে বোঝাপড়া

শেখ ফজলুল করিম মারুফ:

১. বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশই একমাত্র সংগঠন যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে না থেকেই দেশব্যাপী জনভিত্তি তৈরি করেছে এবং পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের দৃশ্যত কাজ আছে আলহামদুলিল্লাহ।

বাংলাদেশের সংগঠনগুলোর মধ্যে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থেকে গঠিত হয়েছে। আ লীগ, জামায়াত বাংলাদেশে না বরং পাকিস্তান আমলের সংগঠন। স্বাধীনতার পরে আরো বহু সংগঠন তৈরি হলেও জনভিত্তি তৈরি করতে পারেনি। (নেতার ব্যক্তিগত প্রভাব ও ইমেজের কারণে সংসদে আসন পাওয়া আর সংগঠনের জনভিত্তি যে এক জিনিস না এটা নিশ্চই জানেন)

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এই সাফল্যের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো এর নীতি স্পষ্টতা ও নীতিতে অটল থাকা। একেবারে শুরু থেকেই আইএবি স্পষ্ট করে কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশনা পালন, খোলাফায়ে রাশেদা ও সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণ করার নীতি ঘোষণা করেছে এবং ইসলামের স্বার্থকে সর্বক্ষেত্রে প্রধান্য দিয়েছে।

কোন ধরনের ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা-মতলবি ব্যাখ্যা করে কোন ধরনের সুযোগ সুবিধার পেছনে ছোটে নাই।

এই নীতি অবিচলতার কারণে অন্তত দুইবার দেশের সমগ্র ইসলামপন্থীরা আইএবিকে বয়কট করেছে। ২০০১ এর নির্বাচনে ও ২০১৩ এর হেফাজতকান্ডের সময়। এই দুই সময়েই মনে হয়েছে আইএবি এবার আর ঘুরে দাড়াতে পারবেনা। আজ ২০২০ এ এসে এখন সবাই জানে কে ঘুরে দাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর কে হারিয়ে যাচ্ছে।

দীর্ঘ পথচলায় আইএবির এই স্পষ্ট নীতি ও নীতি অবিচলতাকে বারংবার নানা তত্ত্বে ও মিথ্যা তথ্যে নিন্দা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী এই স্পষ্ট নীতি ও নীতি অবিচলতাই আইএবিকে স্বাতন্ত্রিক অবস্থানে এনে দাড় করিয়েছে এবং ক্রমাগত এগিয়ে দিচ্ছে।

২. ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একটি তাসাউফপন্থী শুদ্ধ ধারার ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠন। তাসাউফ সম্পর্কে পাকিস্তানি এক চিন্তকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেকে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। বাংলাদেশে ইসলাম প্রসার ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে কোন ধরনের জানাশোনা ছাড়াই কেউ কেউ পন্ডিত-পন্ডিত ভাব নিয়ে আইএবির এই তাসাউফ সম্পৃক্ততাকে “পীরতন্ত্র” বলে নিজেদের মুর্খতা জাহির করে।

বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য পড়াশোনা করলেই এরা জানতো যে, বাংলাদেশ আবাদ হয়েছে এবং এখানে ইসলাম এসেছে পীরদের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সুফিরা কেউই জীবনবিমুখ না বরং সকলেই একেকজন সামাজিক রাজনৈতিক নেতা। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দেশের এই ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মানুষের ঐতিহাসিক সংগঠন প্রবনতা বিশ্লেষণ করেই তাসাউফ ও রাজনীতিকে একত্রিত করে দেশের মানুষের ভাগ্য বদলের সংগ্রাম করে।

৩. ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের সংগঠন। তবে ইসলামের এমনকি সকল নবী-রাসুলদের ঐতিহ্য অনুসারে আইএবিতে তথাকথিত “মুর্খ ও গরীব” মানুষদের সংখ্যা বেশি। পৃথিবীর শুরু থেকেই সত্যের পক্ষে তারাই বেশি ছিলেন যাদেরকে বস্তুবাদী দুনিয়াদাররা মুর্খ,বোকা ও গরীব বলেছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বারংবার এদেরকেই জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান আখ্যা দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ! আইএবি বস্তুবাদের দৃষ্টিতে এই “মুর্খ ও গরীব”দের সংখ্যাধিক্যের কারণে আল্লাহর কাছে শুকরিয়াবনত হয়। যাদের কাছে এই ” মুর্খ”দের আধিক্যকে নিন্দাযোগ্য মনে হয় তারা সাবেক সচিব শাহ আব্দুল হান্নান হলেও তাকে বলবো ইসলামের ইতিহাস পড়েন। এবং আপনাদের দৃষ্টিতে “মূর্খদের” মর্যাদা জানতে সুরা আবাসা এর শানে নুজুল পড়েন।

৪. ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে “তত্ত্ব কপচানো” লোক কম। এখানে প্রচুর কাজ করতে হয়। আরাম কেদারায় বসে অনলাইনে “তত্ত্বের জাবরকাঁটা” লোকেরা এখানে টিকতে পারে না। এটা একটি জনমানুষের রাজনৈতিক সংগঠন। এখানে জ্ঞান জাহির করা জরুরী মনে করা হয় না। তাই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে “তত্ত্বের বুঁদবুঁদ” দেখা যায় না। কিন্তু কেউ যদি তার অর্থ করেন যে, এখানে সমাজ বাস্তবতার বিশ্লেষণ হয় না তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের তত্ত্ব জ্ঞান ও চর্চা নিয়ে যাদের সন্দেহ আছে তাদের বলি, দীর্ঘ পথচলায় আজো পর্যন্ত এই সংগঠন কোন ধরনের রাজনৈতিক ভুল করেনি। সমাজ, রাজনীতি, বিশ্ব পরিস্থিতির নিগুঢ় বিশ্লেষণ ও আল্লাহ রহমতের ফলেই এই ভুল এড়ানো সম্ভব হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক সংগঠন। এর মূল্যায়ন তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের যথার্থতায় প্রমানিত হয়। এখানে “তত্ত্বের বুঁদবুঁদ” উঠলো কিনা সেটা মূখ্য না।

৫. ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কোন বিদেশি মডেল অনুসরণ করে সংগঠন চালায় না। সেজন্য আইএবির সংগঠন কাঠামো, নেতৃত্বের ধরন ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া বইয়ের কোন তত্ত্ব দিয়ে শতভাগ বিশ্লেষণ করা যাবে না। আইএবিকে বুঝতে হবে ইসলামের মৌলিক নীতি, বাঙ্গালীয়ানা মনস্তত্ত্ব ও এদেশের ঐতিহাসিক সুফিবাদী চর্চার মধ্যে দিয়ে।

আইএবির অনুসৃত পদ্ধতির যথার্থতা কোন তত্ত্ব দিয়ে না বরং কার্যত এর ফলাফল দিয়ে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আইএবিই একমাত্র সংগঠন যারা আজো পর্যন্ত কোন ভাঙ্গনের শিকার হয় নাই। তত্ত্ব-জ্ঞানে সমৃদ্ধ বহু বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, গবেষক ও আল্লামাদের সংগঠন ভেঙ্গে গেছে কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ আইএবি আজ পর্যন্ত কোন ধরনের বিভেদ-বিভক্তির সম্মুখীন হয় নি। আইএবির সংগঠন কাঠামো, নেতৃত্বের ধরন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে এখন আর কোন তত্ত্ব দিয়ে বিচার করার দরকার নাই বরং আইএবি চর্চা করা পদ্ধতিই এখন বাংলাদেশে বিভক্তিহীন সংগঠন পরিচালনার আদর্শ পদ্ধতি হিসেবে কার্যত প্রমানিত। অন্যরা বরং এটাকে অনুসরণ করতে পারে।

৬. ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সফলতা বিবেচনার জন্য দুইটি বিষয় মনে রাখতে হবে।

প্রথমত, পৃথিবীর শুরু থেকেই ইসলামী আন্দোলনের সফলতা কোন জাগতিক প্রাপ্তির ওপরে নির্ভর করে না। কারো দ্বিমত থাকলে তাকে কোরআন থেকে নবীদের ইতিহাস অধ্যায়ন করতে বলবো।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের ইতিহাস মাথায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের সাথে ইসলামের হাজার বছরের সম্পৃক্ততার ইতিহাস থাকলেও এই ভূখন্ড কখনোই খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ এর অধিনে ছিলো না। এমনকি খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ প্রতিষ্ঠার জন্য তত্ত্ব ও প্রয়োগ উভয় দিক থেকে যথার্থ কোন সংগঠনের ইতিহাসও এদেশে নতুন। এর অর্থ হলো, খিলাফত বা খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে এদেশের মানুষ পরিচিত না। এমনকি ইসলামের রাজনৈতিক বয়ানের অস্তিত্বই এদেশের অনেক ইসলামী অঙ্গনেও অস্বীকার করা হয়। এদেশের মানুষ খিলাফত, উম্মাহ, আদল, ইনসাফ, উলুহিয়্যাতের মতো মৌলিক ধারনাগুলোর সাথেই পরিচিত না। একই সাথে বিশ্ব পরিস্থিতিও বিবেচনায় রাখতে হবে। এমত পরিস্থিতিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এখনো দেশে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলো না বলে হতাশ হওয়া বিবেকবানের জন্য শোভনীয় না। হ্যা! প্রত্যাশা তো থাকতেই হবে।

৭. ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৭১, ৫২ নিয়ে এদেশের ইসলামপন্থীদের অস্বস্তি ও গাঁ ছাড়া মনোভাব ত্যাগ করে ৭১ কে আত্মস্থ করেছে এবং ৭১ এর মুল চেতনাকে ভিত্তি করেই রাজনৈতিক বয়ান নির্মান করছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুহতারাম সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম, শায়খে চরমোনাই একজন সুফিবাদী পীর হয়ে যেভাবে কপালে ও বুকে পতাকা বেঁধে রাজপথ প্রদিক্ষণ করেন তা এদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতিতে এক অনন্য ঘটনা। একই সাথে দেশের রাজনীতিতেও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ৭১ ও ইসলামকে যারা পরস্পর সাংঘর্ষিক দেখাতে চান তাদের জন্য এটা একটা রাজনৈতিক ও আদর্শিক চটপোঘাত। এদেশের ইতিহাসের গভীর অনুধাবনই আইএবিকে এখানে নিয়ে এসেছে।

৮. ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতির বহুদিনের ধারা ভেঙ্গে জনমানুষের রাজনীতি করে। গত জাতীয় নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ যে বয়ান নিয়ে মানুষের কাছে গিয়েছে তার পুরোটাই সম্পুর্ন অর্থে দেশের উন্নয়ন ও মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বয়ান। ইসলামপন্থীদের বহুদিনের চর্চিত “ইসলাম সম্পর্কিত কাঁচা আবেগ” নির্ভর রাজনীতি থেকে সরে এসে আইএবি মানুষের স্বার্থ আদায়ের রাজনীতি করে। শায়খে চরমোনাই এর গত তিন-চার বছরের রাজনৈতিক বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে যেকেউ এর সত্যতা পাবেন।

৯. ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দেশের সবচেয়ে উদার সংগঠন। এই সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব সব ধরনের নতুন চিন্তা, প্রথার বাহিরে চিন্তা, আলোচনা, সমালোচনাকে স্বাগত জানায় এবং এসবের মধ্যে দিয়ে কোন ভালো ও উত্তম পন্থা বেড়িয়ে এসে সেটা সাদরে গ্রহণ করেন। যারা মনে করেন, প্রথার বাইরে কথা বললে এখানে কোনঠাসা হতে হয় তারা ভুল জানেন। এখানে বরং সৃষ্টিশীল নয়, গতানুগতিক হলেও পিছিয়ে পড়বে। কেউ কেউ দেখি বলার চেষ্টা করে যে, তিনি কিছু বলতে গিয়ে বিরাগভাজন হয়েছেন। আমি এই নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, তিনি ভুল বলছেন। যথাযথ পদ্ধতি মেনে যথাযথ লোকের কাছে উত্থাপিত কোন নতুন চিন্তা, প্রথা বিরুদ্ধ চিন্তা বা সমালোচনা এখানে নিরৎসাহিত করা হয় না।

১০. ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এদেশের মানুষের মনস্তত্ত্ব, ঐতিহাসিক ধারা প্রবনতা, রাজনৈতিক বাস্তবতা ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে নিজেদের পথচলাকে একাধিক পর্যায়ক্রমে ভাগ করেছে। সেই পর্যায়ক্রমগুলো উত্তরণের কৌশল ও কর্মসূচি নির্ধারণ করেছে এবং সেমতেই পথ চলে। আলহামদুলিল্লাহ! আইএবির কোন কাজ বা কোন নিশ্চুপ থাকা কোনটাই অযত্নে অবহেলা বা অজান্তে নয়। বরং সবগুলোই চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিশ্লেষণের পরেই হয়।

উপসংহারে বললো, যেহেতু এখনো আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিপ্লব হয়নি তাই হৃদয়ের ব্যাকুলতা থেকে অনেকেরই হয়তো মনে হয়, এটা করা যেতো, এটা করলে ভালো হতো।

এই ব্যাকুলতা প্রশংসনীয়। এই রকম মনে হওয়াও ভালো লক্ষণ। এর অর্থ হলো, আমাদের সবাই বিপ্লবের জন্য ভাবছে, চিন্তা করছে ও কাজ করছে। সংগঠন এগুলোকে কেবল প্রশ্রয়ই দেয় তাই না বরং উৎসাহিত করে।

কিন্তু এগুলো দেখে কেউ যেনো সংগঠনের নীতি, কৌশল, কর্মসূচি, দক্ষতা, যোগ্যতা ও যথার্থতা নিয়ে সংশয় পতিত না হন। উপর্যুক্ত বোঝাপড়াগুলো চিন্তা করলে নিজেই বুঝবেন, আল্লাহর রহমতে এই সংগঠন কত সফলতার সাথে যথার্থ নীতি-কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দরকার আমাদের নিজেদের আত্মনিবেদন বৃদ্ধি করা। নিজেদের কাজের পরিমান বৃদ্ধি করা।

তাহলেই এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সংগ্রাম সফলতা পাবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক: সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি; ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন



source https://deshdunianews.com/%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%80-%e0%a6%86%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%8b%e0%a6%b2%e0%a6%a8-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6/

0 Comments