কওমি আলেমদের আর্থিক অসচ্ছলতা : কারণ ও প্রতিকার

মতামত কলাম:  বর্তমান সময়ে পুরো বিশ্ব করোনা মহামারীতে আক্রান্ত। থেমে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। স্থবিরতা নেমে এসেছে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে।বিশ্বের ব্যস্ততম নগরীগুলোতে এখন রাজ্যের নীরবতা। সবাই ঘরবন্দী। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। হঠাৎ এই দুর্যোগে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের নানা শ্রেণির মানুষও চরম বিপাকে পড়েছে। সবকিছু স্থবির হয়ে পড়া এই সময়ে মানুষের জীবিকা নির্বাহের বিষয়টি হয়ে গিয়েছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। করোনাভাইরাসের থাবা থেকে বাঁচতে পারলেও না খেয়ে মরার শঙ্কায় রয়েছেন অনেকে। তবে সরকারী-বেসরকারী নানা উদ্যোগের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ কিছু ত্রাণ পাচ্ছে। যা দিয়ে তারা প্রাথমিকভাবে করোনার ধাক্কা সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন।

তবে বিপদের গভীরতা বোঝা যাবে সময় গড়ালে। সংকটপূর্ণ এই সময়ে যারা বেশি বিপাকে পড়েছেন তাদের অন্যতম হলেন কওমি ও প্রাইভেট মাদরাসার শিক্ষক,মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা। তাঁদের সামাজিক অবস্থান ও ইলমি আত্মমর্যাদাবোধের কারণে তাঁরা না পারছেন কারো কাছে বলতে, না পারছেন সইতে। বিশেষ করে আজকে আমার লেখার মূল বিষয় কওমি মাদরাসা শিক্ষকদের নিয়ে। যারা নিরবে নিভৃতে দেশ ও জাতির বড় একটি অংশকে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে মানুষ করে তুলছেন, দেশের অধিকাংশ ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন,দেশের যেকোনো দুঃসময়ে যারা এগিয়ে আসেন, তাঁদের এখন চরম দুর্দিন। এ বিষয়ে আমি অধমের কাছে অনেক বড়ভাই, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষী মনের দুঃখ যাতনার কথা শুনিয়েছেন। অনেকে ফোন করে নিজেদের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করে বলেছেন, চরম দুর্দিন নেমে এসেছে তাঁদের জীবনে। অনেকের কাছে ওষুধ কেনার টাকা পর্যন্ত নেই। অধিকাংশই অভিযোগ করেছেন মাদরাসা থেকে প্রাপ্য সম্মানী তাঁরা পাননি। কেউ কেউ সামান্য কিছু পেয়েছেন, যা দিয়ে তার সবকিছু সামাল দেয়া অসম্ভব।কারণ কওমি মাদরাসার বেতন আর কতোই বা! একে বেতন বলা যায় কি না, শিক্ষকদের এমন সম্মানী হয় কি না সেটিও একটি প্রশ্ন!

এদিকে এই সংকটকালীন সময়েও কওমির কতিপয় উদ্যোগী ভাই কওমি মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য বিভিন্নভাবে তহবিল গঠন করছেন। চেষ্টা করছেন ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও তাঁদের পাশে দাঁড়াতে। এটিও নিঃসন্দেহে কওমির শক্তিশালী ও মানবিক ঐতিহ্যের একটি অংশ৷ তবে অনেক কওমি শিক্ষকের আর্থিক অসচ্ছলতা দেখে মনেমনে খুব কষ্ট অনুভব করছি। মনের মধ্যে পুরনো সেই ব্যাথা আবার নতুন করে জেগে উঠেছে। বারবার শুধু একটি বিষয়ই মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে – কেন নবির ওয়ারিসরা এমন অসচ্ছলতার জীবন ঝাপন করবেন,কেন তাঁরা অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হবেন!

আসলে এসব নিয়ে অনেক আগ থেকেই আমি ভেবে আসছি৷ নানা জনের সাথে এ বিষয়ে মতবিনিময় করেছি। সংকটের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি৷ তাছাড়া দীর্ঘ একযুগ কওমি মাদরাসায় অধ্যয়ন করার ফলে অনেক সমস্যাই কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন উপলক্ষে ভ্রাতৃপ্রতিম অনেক মাদরাসায় গিয়েছি৷ দেখেছি সেখানকার ভেতর বাহির৷ সবকিছু মিলিয়ে এ বিষয়ে কিছু খোলামেলা, নির্মোহ ও সরল আলাপ দরকার বলে মনে করছি। কারণ, এই সংকট একদিনের না। করোনাভাইরাস এসেই এই সংকট তৈরি করে দেয়নি। বরং এটি দীর্ঘ সময় ধরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা বহুল আলোচিত ও চর্চিত একটি সমস্যা।

মোটকথা বেতন সমস্যা, শিক্ষকদের আর্থিক অসচ্ছলতা ও কওমি মাদরাসা সবসময় একই সমান্তরাল রেখায় অবস্থান করেছে। পৃথিবীর অনেক কিছুতে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এ বিষয়টি যেন পরিবর্তন হওয়ার নয়। বেতন-বঞ্চনা যেন আজন্ম নিয়তি কওমি শিক্ষকদের। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য আছে। তবে ব্যতিক্রম নিয়ে কিছু বলার নাই। ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হয় না। এখানে বলে রাখা ভাল, কওমি মাদরাসা ছাড়া আলিয়া ও প্রাইভেট মাদরাসায় যারা শিক্ষকতা করেন তাদের বড় একটি অংশ কওমি মাদরাসা থেকে আসেন। অথচ আলিয়া মাদরাসা বাদে কওমি ও প্রাইভেট মাদরাসায় প্রায় ৫০ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। আর এর ৯৫ ভাগ কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী । তো চলুন প্রথমেই কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের গন্তব্য সম্পর্কে একটু আলোচনা করি। অর্থাৎ পড়ালেখা শেষ করে তাদের গন্তব্য কোথায় হয়, কী করেন তারা এসব বিষয়ে আলোকপাত করি। তাহলে শিক্ষকদের বিষয়টি সহজেই দৃশ্যমান হবে।

পড়াশোনা শেষ করার পর কওমি শিক্ষার্থীদের গন্তব্য:

পড়াশোনা শেষ করার পর কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সাধারণত গন্তব্য হয় শিক্ষকতায়। শিক্ষকতাই থাকে তাদের পছন্দের শীর্ষে। এর পাশাপাশি ইমামতি ও খতিব পেশাতেও অনেকে যুক্ত হতে চান এবং যুক্ত হয়ে থাকেন। ওয়াজ-মাহফিল, লেখালেখি, অনুবাদ ইত্যাদি পেশায়ও জড়িত হন অনেকে। ব্যবসা-বাণিজ্যে খুব একটা আসতে চান না তেমন কেউ। যারা আসেন তারা ট্রাভেল এজেন্সি, আতর -টুপি, মধু, টেইলারিং, লাইব্রেরি ইত্যাদির ব্যবসা সাধারণত করে থাকেন। তবে এদের সংখ্যা খুবই কম। তবে কেন ব্যবসায় আসেন না বা ব্যবসায়ী হতে চায় না কওমি পড়ুয়ারা সেটি পরে বিস্তারিত লিখছি। আর যারা ব্যবসায় পুঁজি খাটাতে সক্ষম হন না, মাদরাসায় শিক্ষকতার জন্য পদও খালি পান না, তারা অনেকেই বেছে নেন টিউশন পেশাকে। দু-তিনটে টিউশনি দিয়েই কর্মজীবনের প্রাথমিক ধাপ অতিক্রম করেন তারা। পাশাপাশি অপেক্ষায় থাকেন মসজিদ-মাদরাসায় কোন পদ খালি হওয়ার, অথবা দিন পার করেন অন্যকোন পছন্দসই পেশায় যুক্ত হওয়ার আশায়৷

আর্থিক অসচ্ছলতার কারণ:

কওমি মাদরাসা শিক্ষকদের আর্থিক দৈন্যদশার অনেক কারণ রয়েছে। নিম্নে কিছু কারণ উল্লেখ করা হল।

১.কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাব: কওমি মাদরাসায় কেন্দ্রীয় কোন নেতৃত্ব নেই। প্রায় ৩০/৪০ হাজার কওমি মাদরাসা থাকলেও এগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য শক্তিশালী কোন কর্তৃপক্ষ নেই৷ কওমি মাদরাসাগুলো স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত। দায়বদ্ধ নয় কারো কাছে। অর্থাৎ কওমি মাদরাসাগুলো নির্দিষ্ট মুহতামিম /পরিচালক কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। মুহতামিমদের ইচ্ছাই কওমি মাদরাসায় শেষ কথা। তাঁরা কেন্দ্রীয় কোন নেতৃত্বের কাছে দায়বদ্ধ নয়। জবাবদিহির তেমন কোন বিষয় নেই তাদের। কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক যে বোর্ডগুলো রয়েছে সেগুলো দেশের সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর মতো শক্তিশালী, কার্যকর ও সুশৃঙ্খল নয়। বরং নিতান্তই পরীক্ষা-সর্বস্ব । এই বোর্ডগুলোর কাজ শুধু পরীক্ষা নেয়া, ফলাফল প্রকাশ এবং পুরস্কৃত করা। উপরন্তু যারা বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন, বোর্ডের বিভিন্ন পদে আছেন, তাঁদের যোগ্যতা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কেউ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না, কেউ বর্তমান বৈশ্বিক শিক্ষাব্যবস্থার গতি প্রকৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন, কেউ বা রাজনীতির সাথে জড়িত, ইত্যাদি। যার ফলে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কোন নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি এখনো পর্যন্ত। ফলে কেন্দ্রীয়করণও আর হয়ে ওঠেনি।

২.কর্মসংস্থান সংকট:
বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, আবেগ ও অনুভূতির কারণে প্রতি বছর মাদরাসায় শিক্ষার্থী বাড়ছে। একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর তারা আলেম হয়ে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু সেই অনুপাতে তাদের চাহিদা নেই বা তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না বা করা হচ্ছে না। দেশে যেসব ধর্মীয় সেক্টর আছে সেখানে তাদের কিছু কর্মসংস্থান হয় বটে। তবে সেটি সংখ্যায় নিতান্তই কম।কারণ, আলিয়া মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি বিষয় থেকে পড়ে আসা শিক্ষার্থীরাও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। বরং তারা (আলিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী) সরকারী সার্টিফিকেট থাকায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকে। সরকারী ও অধিকাংশ বেসরকারী ধর্মীয়সহ অন্যান্য পদ চলে যায় তাদের দখলে। ফলে কওমি শিক্ষার্থীদের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসে অনুমিতভাবেই৷ ক্রমশ চাপ বাড়তে থাকে কওমি মাদরাসা ও মসজিদগুলোয়। সেই অনুপাতে প্রতিবছর তো আর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বাড়ছে না। পদও সৃষ্টি হচ্ছে না কর্মসংস্থানের চাহিদা অনুসারে।অনিবার্য পরিণতিতে কওমি শিক্ষার্থীরা (আলেমরা) কওমি মাদরাসা, ফোরকানিয়া মাদরাসা-মক্তবে, মসজিদের ইমাম-খতিব ও খাদেম পদে নামমাত্র বেতনে শ্রম বিনিয়োগ করছেন। যে বেতনে আসলে জীবন ধারণ করাই কঠিন।

৩.সরকারী বেসরকারী পলিসির বাইরে থাকা: সরকার দেশে কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করে। সেখানে বেকার বা কর্মহীনদের জন্য সরকারের নানা পলিসি থাকে। দুঃখজনকভাবে কওমি আলেমরা এই পলিসির বাইরে পড়ে যান। বেসরকারী খাতও সরকারি খাতের অনুসরণ করে। স্পষ্টভাবে বললে সরকারী-বেসরকারী জনবল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষাগত যোগ্যতায় যে যোগ্যতা বা ডিগ্রি চাওয়া হয়, সেটি থেকে বহুদূরে থাকে কওমি শিক্ষার্থীরা। সাধারণত কওমি মাদরাসা যে ডিগ্রিগুলো দেয়, আমাদের দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতা সেগুলোর পুরোপুরি বিপরীত। সেসব ডিগ্রিকে কেউ আমলে নেয় না। তাই, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অথবা প্রতিষ্ঠানের ধর্মীয় দিক বাদে কওমি মাদরাসা পড়ুয়া কাউকে সরকারী বেসরকারী কোন সাধারণ পদের জন্য বিবেচনা করা হয় না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও পদে আলিয়া মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে তো লড়তে হয়ই কওমি শিক্ষার্থীদের।

৪. কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শীতা ও উদাসীনতা : কওমি মাদরাসাগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের অদূরদর্শীতা ও উদাসীনতা এখানে অন্যতম কারণ। মাদরাসায় একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পর তার পড়ালেখার উন্নতি অগ্রগতির জন্য কর্তৃপক্ষ যেভাবে মাথা ঘামায় এবং সচেষ্ট থাকে, সেভাবে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নিয়েও কর্তৃপক্ষকে সচেষ্ট হতে হতো। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যদি তারা সচেষ্ট হতো তবে এতোদিনে অবশ্যই কোন না কোন উপায় বের হতো। দুঃখজনকভাবে সেটি হয়নি৷ হয়ে ওঠেনি।

৫.ধর্মীয় বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা : মাদরাসায় শিক্ষকতা, মসজিদের ইমাম-খতিব হওয়ার তীব্র আকাঙক্ষা থাকে কওমি শিক্ষার্থীদের মনে। কওমি মাদরাসায় পড়ুয়া প্রায় শিক্ষার্থী ছাত্রাবস্থায় থেকেই নিজেকে মাদরাসার পরিচালক,শাইখুল হাদিস, মসজিদের খতিব হিসেবে কল্পনা করে থাকে। ফলে অন্যকোনো পেশায় জড়ানোর চিন্তাভাবনা তাদের তেমন থাকে না। প্রস্তুতিও থাকে না সেভাবে। পড়াশোনা শেষ করার পর সেই আকাঙক্ষা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি৷ কিন্তু প্রতি বছর কি পদ খালি হচ্ছে? মাদরাসার পরিচালক, শাইখুল হাদিস, ইমাম-খতিব এই পদগুলো তো অনেকটা জীবনভর (Lifetime) চাকরি বা দায়িত্বের মতো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু ছাড়া এসব পদ খালি হয় না। অন্তত আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা তা-ই নির্দেশ করে। তাহলে পদ খালি কীভাবে হবে? প্রতিবছর কি আলেমদের সাথে সাথে মাদরাসা-মসজিদের সংখ্যা বাড়ছে?

৬.মসজিদ মাদরাসায় বৈরাগ্য: অনেকেই আছে কওমি মাদরাসায় পড়ার পর মসজিদ মাদরাসায় লেগে থাকতে চায়৷ অনেকটা যাজকশ্রেণী ও পুরোহিতদের মতো! যারা কখনো তাদের উপাসনালয় থেকে বের হয় না, সেখানেই জীবনবকাটিয়ে দেয়। কওমি মাদরাসাতেও কেমন করে যেন এই বিষয়টি স্থান করে নিয়েছে। যার বাহ্যিকরূপ সুন্দর মনে হলেও সার্বিক বিবেচনায় সেটি অন্তঃসারশূন্য ও আত্মঘাতী। নইলে যেকোনো উপায়ে বা মূল্যে মসজিদ মাদরাসায় লেগে থাকাকেই সবচে’ ভাল পেশা হিসেবে মানা হবে কেন? কেন দীনদারির নামে এভাবে মাদরাসায় পড়ে থাকা? আসলে এই বিষয়টি চলে এসেছে অনেকটা ঐতিহ্য ও পরম্পরা রক্ষা করে। ছাত্র দেখে শিখেছে যে তার শিক্ষক শিক্ষকতা করছে, এ থেকেই জীবিকা নির্বাহ করছে, শিক্ষক তার শিক্ষককেও এভাবে দেখেছে। শিখেছে। ধারণ করেছে। ফলে এভাবেই পরম্পরা সৃষ্টি হয়েছে। ব্যতিক্রম হয়েছে খুবই কম। যা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেনি।

৭.উদ্যোক্তা হতে অনাগ্রহ: উদ্যোক্তা হতে এদেশের তরুণরা এমনিতেই ভয় পায়। বিশেষ করে শিক্ষিত শ্রেণী। তারা ভাবে পড়াশোনা শেষ করে বড় কোন চাকরি করতে পারলেই তার শিক্ষালাভ যথার্থ হয়েছে, কষ্ট ও শ্রম সফল হয়েছে। অন্যদিকে কওমি অঙ্গনে অনাগ্রহের অনেক কারণের অন্যতম কারণ হলো, কওমি শিক্ষার্থীদের বিরাট একটি অংশ আসে দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে। (এখনো পর্যন্ত উচ্চবিত্ত থেকে কওমি মাদরাসায় পড়তে আসাদের সংখ্যা অনেক কম) ফলে তারা (নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী) ১২-১৫ বছর পারিবারিক খরচে লেখাপড়ার পর উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য পারিবারিকভাবে তেমন কোন সাহায্য-সহযোগিতা পায় না। যা দিয়ে সে ব্যবসাকে দাঁড় করাবে,মূলধন হিসেবে কোন খাতে বিনিয়োগ করবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে না আসার আরেকটি কারণ হল, একটি ভুল ও অন্যায্য প্রচারণা। সেটি হলো, কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হলে, বলা হয়ে থাকে যে তার ‘ইলম কবুল হয়নি’। বা তাকে ‘আল্লাহ ইলমের সাথে রাখেননি’। এই নেতিবাচক প্রচারণার ফলে অনেকেই নতুন কিছু করার চেষ্টা করতে চাইলেও পিছিয়ে গেছেন। ফলে তেমন কোন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়নি।

৮. কওমি মাদরাসার টাইট শিডিউল : কওমি মাদরাসার রয়েছে নির্দিষ্ট একটি পাঠ্যক্রম। যা একজন শিক্ষার্থীকে ইসলামের পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে৷ এই জ্ঞান অর্জন করতে শিক্ষার্থীদের থাকতে হয় সম্পূর্ণ শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশে শিক্ষকের সুনিবিড় তত্ত্বাবধানে। শিক্ষার্থীদের এই তত্ত্বাবধান কাজে নিয়োজিত থাকতে হয় শিক্ষকদের। ফলে শিক্ষকদের সারাদিন চলে যায় শিক্ষার্থীদের পেছনে। তদুপরি ক্লাস শেষ হওয়ার পরেও সুনিয়ন্ত্রিত হোস্টেল ব্যবস্থাপনার কাজ, শিক্ষার্থীদের যাবতীয় দেখভাল করতে হয় বেচারা শিক্ষককে। ফলে ঘুম ছাড়া শিক্ষক তেমন কোন সময় নিজের জন্য ব্যায় করার ফুরসত পান না। তাছাড়া গড়ে ৫-৭ টি ক্লাসে পাঠদানের দায়িত্ব তো আছেই।

৯.মুহতামিমদের একচেটিয়া আধিপত্য: কওমি মাদরাসায় পরিচালক -মুহতামিমরা একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকেন। এখানে তাদের কথাই শেষ কথা। বিশেষ করে মুহতামিম যদি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা বা তাঁর আত্মীয়-স্বজন হন। যেহেতু এদের উপর কারো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, সেহেতু তারা ভোগ করেন কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মতো স্বাধীনতা। তাদের কথাই আইন তাদের কথাই নিয়ম সেখানে। ফলে তারা হয়ে ওঠেন অনেক ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী। অনেক মুহতামিম ও পরিচালকের চোখে মাদরাসার অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সুনাম ও শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষকদের বেতনের সংস্থান করা এদের কাছে দূরের বিষয়। ব্যতিক্রম মুহতামিম যে নেই তা কিন্তু নয়। তবে আনুপাতিক হারে তাদের সংখ্যা হয়ত কমই।

১০.মাত্রাতিরিক্ত চাঁদা-দান-খয়রাত নির্ভরতা: কওমি মাদরাসাগুলোর দুর্বলতা ও শিক্ষকদের আর্থিক সংকটের অন্যতম কারণ হল এটি। ভারতবর্ষে যখন ইসলাম ও মুসলমানদের দুর্দিন চলছিল, বৃটিশ শাসক কর্তৃক মুসলমানদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, তখন এই সরকারী শ্যেনদৃষ্টি এড়ানোর জন্য চাঁদা ও দান-খয়রাতের বিষয়টির উদ্ভব হয়েছিল। অবস্থা এখন পরিবর্তন হয়েছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ এখন ইসলামের উর্বর ভূমি তবু কেন এখনো সেই পুরনো নিয়মনীতি ব্যাপকভাবে চর্চিত হবে? এখনো কেন বিপুল পরিমাণ কওমি মাদরাসা শুধু দান-খয়রাত ও চাঁদার উপর নির্ভরশীল থাকবে? যেটি একটি আত্মঘাতী, অস্থায়ী ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত বলেই প্রমাণিত হচ্ছে৷ এখনো কওমি মাদরাসাগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি গ্রহণ করে না। শুধু ভর্তি, খাবার,হোস্টেল ও পরীক্ষার ফি গ্রহণ করে যথেষ্ট সাশ্রয়ী মূল্যে। তাছাড়া বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী এতিম-মিসকিন কোটায় একদম বিনামূল্যে শিক্ষা অর্জন করে যাচ্ছে। ফলে কওমি মাদরাসার কোষাগারগুলো চাইলেও সমৃদ্ধ হতে পারছে না। সবার ক্ষেত্রে অবশ্য এই অবস্থা নয়। অনেক মাদরাসার কোষাগার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তবে তারা এই টাকা অলস ফেলে রেখে সেটাকে বাড়ানোর চেষ্টা করছে না। আবার চাঁদা-দান-খয়রাতও নিয়মিত গ্রহণ করে যাচ্ছে। ফলে সময়ের সাথে অর্থের যোগান না বাড়ায় কওমি শিক্ষকরা সমৃদ্ধ কোষাগারের সুবিধা ভোগ করতে পারছে না।তাদের বেতনও বাড়ছে না উল্লেখযোগ্য হারে।

১১. ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনার অভাব: কওমি মাদরাসাতে দীন শিক্ষা দেয়া হয়। সারা বছর নির্দিষ্ট একটি নিয়ম মেনেই শিক্ষার্থীরা এখানে থাকে। প্রতিদিন একই পদ্ধতিতে শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে থাকে৷ এমনকি যখন পড়ালেখা শেষদিকে চলে আসে তখনও করণীয় সম্পর্কে তেমন কোন নির্দেশনা মাদরাসা থেকে দেয়া হয় না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যারিয়ার নিয়ে যেভাবে ওয়ার্কশপ-সেমিনার হয় তার সিকিভাগও মাদরাসাগুলোয় হয় না। ফলে একজন শিক্ষার্থী মাদরাসা থেকে বের হয় নিজেকে নিয়তির উপর ছেড়ে দিয়ে। এছাড়া আরো কিছু কারণ থাকতে পারে। আপাতত সেগুলো অনুল্লেখ থাকল।

প্রতিকারের উপায় :

বেশকিছু উপায় অবলম্বন করলে ধীরেধীরে কওমি শিক্ষকরা সচ্ছল হয়ে উঠবেন। আর্থিকভাবেও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন। নিম্নে কিছু বিষয় উল্লেখ করা হল।

১. শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা : কওমি মাদরাসাগুলো কোন কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে দায়বদ্ধ নয়৷ নিয়ন্ত্রিত নয় কোন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক। অনেকটা ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপর প্রতিষ্ঠিত এসব মাদরাসা। তাই অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়ত সম্ভব নয় কওমি মাদরাসায়। পাছে না আবার তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে বসে। তবে আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যা বাংলাদেশ নামে যে সম্মিলিত বোর্ড গঠিত হয়েছে, সেটিকে প্রাজ্ঞ, গবেষক, চিন্তাশীল ও অরাজনৈতিক আলেমদের দিয়ে শক্তিশালী করা যায়। শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা, শিক্ষকদের বেতন কাঠামো, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতার আলোকে কওমি সিলেবাসকে আরো বেশি কর্মমুখী করে সাজানো, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য উৎসাহ ও প্রণোদনা ফান্ড গঠন, সংকটকালে অনুসৃত নীতি – ইত্যাদি বিষয়ে হয়ত ভূমিকা রাখতে পারবে এই বোর্ড।

২. চাহিদা ও যোগানের সমন্বয় করা : চাহিদার বিপরীতে যদি যোগানের আধিক্য থাকে তবে সমস্যা দেখা দেবেই৷ এক পদের বিপরীতে যদি ৩০/৪০ জন থাকে, একজন ছাড়া সকলেরই বঞ্চিত হতে হবে। তাই কওমি কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে যে মসজিদ মাদরাসাকেন্দ্রিক (আরো কিছু খাত আছে) আদৌ এতো বিপুল সংখ্যক আলেম প্রয়োজন আছে কি না? উত্তর যদি না হয় তাহলে এখানে যোগান কমিয়ে ফেলতে হবে। অর্থাৎ যারা মেধাবী ও নির্দিষ্ট মানে ফলাফল অর্জন করবে তারাই কওমি মাদরাসার উচ্চস্তরে পড়ালেখা করে আলেম হওয়ার সুযোগ পাবে। যারা উপর্যুক্ত শর্ত পূরণ করতে পারবে না, তারা যেন মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়ে দেশের সাধারণ শিক্ষায় যুক্ত হতে পারে সেই সুযোগ অবারিত রাখা হোক। এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল ও শিক্ষাবোর্ডের সাথে সমন্বয় করে কাজ করল নগদ ফলাফল পাওয়া যাবে।।আর যারা পুরো পড়ালেখা শেষ করবে তাদের কর্মসংস্থানের যাতে সংকট না হয়, তারা যাতে সম্মানের সাথে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে সেজন্য পরিকল্পিত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হোক।

৩.সরকারী ও বেসরকারী পলিসির সাথে সমন্বয় করা : দেশের নাগরিক হিসেবে সরকারি পলিসির মধ্যে থাকার অধিকার সবার রয়েছে। কারণ সরকার সবার। নির্দিষ্ট কোন দল বা পক্ষের নয়। সরকারকে সবাই সবরকমের কর দেয়। দিতে বাধ্য থাকে৷ তাহলে সরকারও তার পলিসির মধ্যে কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য। বেকারত্বের হারের আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশের যে অবস্থান,( মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে বিশ্বে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫তম। ভোরের কাগজ, ১৩ মার্চ ২০২০) সেটিকে উন্নত করতে হলে সরকারকে অবশ্যই কওমি শিক্ষার্থীদের নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। এক্ষেত্রে গত কয়েক বছর আগে যে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে সেটিকে জোরালোভাবে কাজে লাগানো উচিত। আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে যে নিয়মনীতি রয়েছে সেটিকে সংশোধন করে আরো ব্যাপক করা উচিত৷ যাতে কওমি শিক্ষার্থীরা এসব ক্ষেত্রে নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ লাভ করে। বিশেষ করে যে সমস্ত চাকরি নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত নয়, সবাই করতে পারে এমন সাধারণ চাকরির ক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে জোরালো লবিং ও শক্তিশালী পদক্ষেপ নিলে এ বিষয়ে জট খুলতে পারে। তৈরি হতে পারে নতুন সম্ভাবনা।

৪. চাঁদা ও দান-খয়রাত নির্ভরতা কমিয়ে আনা: কওমি মাদরাসাগুলোর অধিকাংশ আয় সমাজের মানুষের চাঁদা ও দান-খয়রাত থেকে আসে। এ টাকা দিয়েই কওমি মাদরাসাগুলো তাদের ব্যায় মেটানোর চেষ্টা করে৷ বলে রাখা ভাল যে, মাদরাসার সংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে। যারা চাঁদা দেয় তারা কয়টা মাদরাসাকে চাঁদা দেবে? কী পরিমাণ চাঁদাই বা দেবে? আমার মনে হয়, এই ধারা থেকে আস্তে আস্তে পরিকল্পিতভাবে সরে আসা দরকার। এসব চাঁদা -দান-খয়রাত গ্রহণ করা বৈধ হলেও এর একটা খারাপ দিকও আছে। এসব সংগ্রহ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। বিসর্জন দিতে হয় আত্মমর্যাদা। ইসলাম ও নববী ইলমের সাথেও এটা বেমানান। অমর্যাদাকর। তাছাড়া পান থেকে চুন খসলেই খোটা দেয়ার বিষয়টি তো আছেই৷ এখানে মোটাদাগে যেটি বলতে চাই, যেসমস্ত মাদরাসা তার প্রাথমিক কাল অতিক্রম করে ফেলেছে, মোটামুটিভাবে যাদের কোষাগার শক্ত-পোক্ত হয়েছে তারা মাদরাসার অধীনে কৃষি, গরু,মুরগি ও মৎস খামার, জায়গা- জমি ইত্যাদি খাতে অর্থ বিনিয়োগ করুক। দালানকোঠা নির্মাণ করে ফ্ল্যাট ও কমার্শিয়াল স্পেস ভাড়া দিক। অনায়াসেই মাদরাসার কোষাগার অনেক বেশি সমৃদ্ধ হবে। মাদরাসা যাকাত নেয়ার বদলে যাকাত দিতে পারবে। অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হবে। অনেক শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান হবে।। তাছাড়া সচ্ছল ও মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক টিউশন ফি গ্রহণ করা হোক। এখন দেখা যায়, অনেক শতবর্ষী প্রভাবশালী প্রসিদ্ধ মাদরাসাগুলো কোষাগারে কোটিকোটি টাকা অলস ফেলে রাখে৷ আর প্রতি বছর শিক্ষকদের দিয়ে চাঁদা করিয়ে তাদের খাটিয়ে মারে। বেতন বাকি রাখে। বেতন বাকি রেখে তা নিয়ে বিভিন্ন নৈতিকতার সবক দিয়ে সবরের ফজিলত বর্ণনা করে। সুতরাং এ বিষয়টিকে খুব বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিত।

৫.ইয়াতিম-মিসকিন শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানো: কওমি মাদরাসাগুলো শুরুরদিন থেকে ইয়াতিম-মিসকিনদের শিক্ষা-দীক্ষা, পুনর্বাসন ও সামজিক সুরক্ষার জন্য কাজ করে গেছে। নিরবে এতোটা কাজ কেউ করেছে বলে মনে হয় না। মাদরাসায় যে ইয়াতিম-মিসকিন শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গার্মেন্টস ও আইটি সেক্টরে কাজে লাগানো যায়। মাদরাসার তত্ত্বাবধানে কিছু ছোটখাটো গার্মেন্টস ও আইটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়। সেখানে ইয়াতিম-মিসকিন শিক্ষার্থীরা আবর্তন (Rotation) পদ্ধতিতে সকাল-বিকাল-রাতের কোন এক সময়ে,পড়ালেখার ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সময় দিয়ে নির্দিষ্ট কাজ আঞ্জাম দিয়ে প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করবে৷ মাদরাসা যেহেতু তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে, তারাও মাদরাসার হয়ে কিছু কাজ করতে পারে৷ এতে করে তারা যেভাবে দক্ষ হয়ে ওঠবে, তেমনি মাদরাসার কোষাগারকে সমৃদ্ধ করে নিজেও কিছুটা ঋণমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে পারল। এতে করে তাদের মাঝে হীনমন্যতাও থাকবে না। তাদের মাঝে এই বোধ অবশ্যই তৈরি হবে যে তারা কারো দয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। বরং, নিজের শ্রমে নিজেকে গড়ছে। এমন উদাহরণ আমাদের সমাজে অনেক আছে যে পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

৬.মুহতামিমদের একচেটিয়া আধিপত্য রোধ করতে হবে : আগেই বলেছি মাদরাসাগুলোতে মুহতামিমরা রাজার মর্যাদা ভোগ করেন। তাদের কথাই সেখানে শেষ কথা। এর অবশ্য যথেষ্ট কারণও আছে। অধিকাংশ মাদরাসার মুহতামিম হলেন সেই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা বা প্রতিষ্ঠাতার নিকটাত্মীয়। ফলে তাদের শক্তিশালী প্রভাব সেখানে থাকবে এমনটা স্বাভাবিক। যেভাবে দেশের প্রাইভেট কোম্পানিগুলো হয়ে থাকে। তবুও যতটুকু পারা যায়, নির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় শিক্ষকরা যেন মুহতামিমদের একচেটিয়া আধিপত্যর কারণে নিষ্পেষিত না হোন সেটি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠাতার পর তাঁর নিকটাত্মীয়ের চাইতে মাদরাসায় যাদের অবদান বেশি, তাদের যদি মাদরাসার মূল নেতৃত্বগুলোয় আনা হয়, তাহলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হবে। পাশাপাশি গভর্নিং বডি বা শুরা কাউন্সিলকে যদি স্বাধীন ও শক্তিশালী করা যায় তাহলেও মুহতামিমদের একচেটিয়া আধিপত্য রোধ হবে।

৭.কওমি মাদরাসার টাইট শিডিউল হালকা করতে হবে : কওমি মাদরাসাগুলো কঠোর শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও দায়িত্ব পালন করতে হয় শতভাগ। ক্লাসে পাঠদানের পরও সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য শিক্ষকদের মাদরাসাতেই সারাদিন থেকে যেতে হয়, অনেক প্রতিষ্ঠানে শর্তই দিয়ে দেয়া হয় যে সেখানে চাকরিরত অবস্থায় অন্য কোন কাজে যুক্ত হওয়া যাবে না। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে চাওয়া হয়- মাদরাসার শিক্ষকরা যেন পুরো সময়ই মাদরাসায় দেন। কেউ যদি পুরো সময় না দেন, তবে তিনি যত ভাল যোগ্যতাসম্পন্ন হোন না কেন,তিনি নানামুখী বিরোধিতার মুখে পড়েন। মাদরাসা-কর্তৃপক্ষের সুনজর থেকে দূরে চলে যান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাদরাসাতে চাকরিও থাকে না। এমন হলে হবে না। শিক্ষকদের পুরো সময় ধরে না রেখে কিছু দায়িত্ব কমিয়ে দিতে হবে। যাতে তিনি অন্য কোথাও নিজ যোগ্যতাবলে আরো কিছু আয় করতে পারেন। এতে করে মাদরাসার উপরও চাপ কমে যাবে। আর এটি কার্যকর হবে শিক্ষকদের মধ্যে আবর্তন (rotation) পদ্ধতির মাধ্যমে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তাদের ব্যবহার করতে পারলে এটি সফল হবে বলে আশা করা যায়।

৮.ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্যোক্তা হতে হবে: শুধু মসজিদ-মাদরামুখী না হয়ে উপার্জনের জন্য ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্যোগ নিতে হবে। মাদরাসা থেকে পড়াশোনা করে মসজিদ -মাদরাসায় ক্যারিয়ার না গড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্যারিয়ার গড়লে ‘ ইলম কবুল হয়নি’ মর্মে যে কুধারণা ছড়ানো হয়েছে সেটিকে প্রতিহত করতে ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করার বিকল্প নেই। কুরআন ও হাদিসে ব্যবসা ও যে কোন হালাল উপার্জনকে যথেষ্ট উৎসাহ দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে – “আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’’ (সূরা আল-বাকারা: ২৭৫) হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হযরত রাফে ইবনে খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, সর্বোত্তম উপার্জন কোনটি? জবাবে তিনি বলেন: ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্দ উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়।’’ (ইমাম আহমাদ, মুসনাদ, খ.৪, পৃ. ১৪১) অপর একটি হাদিসে এসেছে -তোমরা ব্যবসা বানিজ্য কর। কারণ তাতেই নিহিত রয়েছে নয়-দশমাংশ জীবিকা’’ (ইহইয়াউ উলুমুদ্দীন, (মাকতবাতুল মুস্তফা আল বাবী ওয়াল হালবী) খ. ২, পৃ. ৬৪। ইমাম ‘ইরাকী ও আলবানি হাদিসটি দুর্বল বলেছেন) আরেকটি হাদিসে এসেছে -ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী (পরকালে) নবী, সিদ্দিকীন ও আল্লাহর পথে জীবন বিসর্জনকারী শহীদদের সঙ্গী হবে।“ (জামে’ আত্-তিরমিযী, হাদীস নং- ১২০৯। (আলবানী এটাকে দুর্বল বলেছেন।) সুতরাং কুরআন হাদিসের এসব উৎসাহকে ধারণ করে কওমি আলেমদের মসজিদ-মাদরাসার আয়ের উপর নির্ভরতা কমিয়ে ব্যবসায় শ্রম বিনিয়োগ করতে হবে। এতে করে মসজিদ-মাদরাসার উপর চাপ কমে কমে আসবে। মসজিদ-মাদরাসা কর্তৃপক্ষের খবরদারীর কাছে নতজানু হয়ে থাকতে হবে না। চাকরি হারানোর ভয় তাড়া করবে না। কারো দয়ার উপর নির্ভরশীল হতে হবে না। বরং অন্যকে সহযোগিতা করতে পারবে।

৯. কওমি মাদরাসায় ক্যারিয়ার সংলাপের আয়োজন করা : কওমি মাদরাসাগুলোতে পড়াশোনার বাইরে ব্যতিক্রমী কোন আয়োজন নেই বললেই চলে। টুকটাক কিছু বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় বটে। তবে সেগুলোর পরিমাণ খুবই কম। মানেরও যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। তাই, মানসম্মত বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি কওমি মাদরাসায় ক্যারিয়ার সংলাপের আয়োজন করা উচিত। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতাই যথেষ্ট। যারা পড়াশোনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে তাদের নিয়ে এই সংলাপ হবে। তাদের উদ্দেশে বার্তা থাকবে একদম পরিষ্কার। কওমি মাদরাসায় পড়ে মসজিদ-মাদরাসায় লেগে থাকতে হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য করা যাবে না, মুহাদ্দিস- শাইখুল হাদিস হতে হবে, উদ্যোক্তা হওয়া যাবে না এমন কোন বিষয় নাই৷ যার যেদিকে আগ্রহ রয়েছে সেদিকে তার যাওয়া উচিত।হালাল যেকোন পেশাই সম্মানজনক।

শেষ কথা : হাদিসে এসেছে ” উপরের (দাতার) হাত নিচের (গ্রহীতার) হাত হতে উত্তম। যাদের ভরণ-পোষণ তোমার দায়িত্বে আছে তাদেরকে আগে দাও। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে সাদকাহ করা উত্তম। যে ব্যক্তি (হারাম ও ভিক্ষা করা থেকে পবিত্র থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখেন এবং যে পরমুখাপেক্ষিতা থেকে বেঁচে থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে অভাবশূন্য করে দেন।’’ ( বুখারি, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১১২) অভাব, পরমুখাপেক্ষিতা কারো জন্য ইতিবাচক দিক না৷ অন্যদিকে দাতার হাতকে উত্তম বলা হয়েছে৷ সুতরাং ইতিবাচকতার পথে হাটতে হবে। নেতিবাচকতাকে জয় করতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, কারো প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে এই লেখা তৈরি করা হয়নি। দুঃখবোধ থেকে দরদ নিয়ে প্রকৃত অবস্থা তোলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। না বলা কথা বলা হয়েছে। আমার সাথে সব বিষয়ে ও পয়েন্টে একমত হওয়া জরুরি নয়। এমনটা সম্ভবও না। জরুরি হচ্ছে প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করে আগামীদিনের সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করা। একদিন হয়ত কওমি আলেমসমাজ এদেশে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে অর্থনীতির লাগাম ধরবে। সেইদিনের প্রত্যাশায়……

আব্দুল্লাহ আল মামুন
ফাযেল, জামেয়া দারুল মা’আরিফ আল ইসলামিয়া, চট্টগ্রাম



source https://deshdunianews.com/%e0%a6%95%e0%a6%93%e0%a6%ae%e0%a6%bf-%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%ae%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%86%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%85%e0%a6%b8%e0%a6%9a%e0%a7%8d/

0 Comments