বাংলাদেশে ইসলামী জ্ঞানচর্চা; একটি পর্যালোচনা

ইসলাম একটি ব্যাপক-বিস্তৃত ও সর্বব্যাপী মতবাদ। বহু ব্যবহারে ক্লিষ্ট বাক্যে বললে, ইসলাম একটি পুর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। সাম্প্রতিক মানে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরের জাতিরাষ্ট্রে ইসলামী আন্দোলনের জনপ্রিয় শ্লোগান ধরে বললে, আল ইসলাম-হুয়াল হল বা ইসলামই সকল সমস্যার সমাধান।
সবগুলোর সারমর্ম এবং সত্য হলো ইসলাম এমন একটা ধর্ম যা মানুষের প্রতিটি মুহুর্তকে দিকনির্দেশনা দেয়। এটা মুত্রত্যাগের পদ্ধতি থেকে নিয়ে আন্তঃমহাদেশীয় সম্পর্ক পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজস্ব ধারনা-ধরন সুপারিশ করে।
ইসলাম মানুষ নিয়ে কাজ করে। সেজন্য আধুনিক বিন্যাসমতে ইসলাম সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। Arts বা কলা অনুষদভুক্ত বিষয়ও তার নির্দেশনার আওতাভুক্ত। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে ইসলাম প্রয়োগ সম্পর্কিত কিছু নীতিমালার অধিনে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে।

আরো স্পষ্ট করে বললে, ইসলাম শুধু আইনের সমষ্টি না। বরং অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, সমাজকর্ম, লোকপ্রশাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যায়ন, উন্নয়ন অধ্যায়ন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ, শিক্ষা গবেষণা, স্বাস্থ্য অর্থনীতি, বিশ্বধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ফিন্যান্স, মার্কেটিং, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ইত্যাদিও বিষয়েও ইসলামের নিজস্ব মুলনীতি, ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রয়োগকৌশল আছে। এইসকল বিষয়ের সমস্যা সমাধানের জন্যও ইসলামের উসুল আছে।
এবং একথা দিবালোকের ন্যায় সত্য যে, শুধু আইন পড়ে এইসকল বিষয়ের পারদর্শী হওয়া সম্ভব না। যদিও মাদ্রাসায় পঠিত আইনের বইগুলো একটু বিস্তৃত। এগুলোর কিছু কিছু সেখানে সামান্য করে স্পর্শ করা আছে। কিন্তু এতটুকু পড়েই যেসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছরের অনার্স-মাস্টার্স ও বহুশ্রমে পিএইচডি হচ্ছে সেসব বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবে কেউ এটা আকাশকুসুম কল্পনা।

দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে ইসলামী জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানগুলোতে এগুলো কিছুই পড়ানো হয় না। গোটা সিলেবাসে ইসলামকে আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে। এমনকি কোরআন – হাদিসকে একমাত্র আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়। উপরে উল্লেখিত কোন বিষয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে অধ্যায়নতো দুরে থাক আলোচনাও হয় না। হ্যা! কোন কোন শিক্ষক নিজস্ব জানাশোনা থেকে কোন কোন বিষয়ে কিছু কথাবার্তা বললেও সেগুলো কোনভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক নয় এবং কাঠামোবদ্ধও নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপরে আবুল ফাত্তাহ মুহাম্মাদ ইয়াহিয়া রঃ একটা সংকলনধর্মী বই ঐচ্ছিক হিসেবে সিলেবাসে ছিলো জানতাম। এতোটুকুই।
অন্য বিষয়গুলো সম্পর্কে কোন আলোচনা হয় না। কোন প্রতিষ্ঠানিক বিভাগও নাই। কোন রচনাও নাই। অথচ অধিকাংশ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রগুলো “জামিয়া”(বিশ্ববিদ্যালয়) নাম ধারন করা।
ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর এই আইন-কেন্দ্রিকতার ফলে বাংলাদেশে চর্চিত গোটা ইসলামী জ্ঞান জগত একচোখা হয়ে যাচ্ছে। এর ফলাফল ভয়াবহ।

সমকালে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় উপর্যুক্ত প্রতিটি বিষয় প্রতিনিয়ত দরকার হচ্ছে। কিন্তু ইসলামী জ্ঞানজগৎ এইসব বিষযে কোন নির্দেশনা দিতে পারছেনা। ফলে এইসব বিষয়ে ইসলাম কার্যকরভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। বাস্তব জীবনের এতোগুলো ক্ষেত্রে যখন ইসলাম অপ্রাসঙ্গিক হয়ে থাকছে সেখানে নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে ইসলামের প্রতি মানুষ কেন আর মুখাপেক্ষী হবে? বাংলাদেশে ধর্মহীনতা বেড়ে যাওয়ার এটা প্রধানতম কারণ। একজন মানুষকে প্রতিনিয়ত স্মিথ, কেইন, মিল, রুশো ইত্যাদি অমুসলিমদের কাছে ধর্না দিতে হচ্ছে দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করার জন্য। এটা করতে করতে তাদের প্রতি একটা ভক্তি, শ্রদ্ধা তো এমনিতেই জন্ম নিচ্ছে। এই ভক্তি-শ্রদ্ধা থেকে তাদের ধর্ম ও নৈতিকতার প্রতিও ভক্তি-শ্রদ্ধা জন্ম নেয়া স্বাভাবিক। এতে তো মানুষ খ্রিষ্টান বা ইহুদি হয়ে যাওয়ার কথা। এর চেয়ে যে ধর্মহীনতার দিকে ঝুকছে এটাই তো বেশি।

নিত্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের এই শাখাগুলোতে ইসলামী জ্ঞানজগতের শুন্যতার ফলে ” ইসলাম একটি পুর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা” এই বাক্য একটি ভুল বাক্যে পরিনত হয়েছে। ইসলাম সব সমস্যার সমাধান এই শ্লোগান হাস্যরসে পরিনত হচ্ছে।
এর অর্থ কি দাড়ালো?
ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর এই এককেন্দ্রিকতা দেশে ধর্মহীনতা উস্কে দিচ্ছে এবং ইসলামের সার্বজনীনতাকে ভুল বলে উপস্থাপন করছে। ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রগুলো তাদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতে ইসলামের কতবড় ক্ষতির কারণ হচ্ছে এটা কি তারা কখনো ভেবে দেখেছে?

ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর এই এককেন্দ্রিকতার আরেকটি বড় সমস্যা হলো, এখান থেকে যেসব ইসলামবিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে তারা আদতে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ। তারা গোটা ইসলামকে ও ইসলামী কার্যক্রমকে আইনের দৃষ্টিতে দেখছে ও ব্যাখ্যা করছে। আইন বাইনারি তথা ০-১ এই দুইটা অপশনের হয়। জায়েজ বা নাজায়েজ। হালাল বা হারাম। বৈধ বা অবৈধ। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানে এই দুই অপশনের বাইরেও অনেক অপশন হতে পারে। বাংলাদেশের ইসলাম বিশেষজ্ঞরা সমাজবিজ্ঞানকেও বাইনারি পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করছেন।

আইনের মুলনীতি ও গবেষণা পদ্ধতি সমাজবিজ্ঞানের অন্য বিষয়গুলোর মুলনীতি ও গবেষণা পদ্ধতির সাথে মিলবেই এটা জরুরি না বাস্তবেও মেলে না। তারপরেও বাংলাদেশে আইনের মুলনীতি দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ফয়সালা হচ্ছে।
এতে যে সমস্যা হচ্ছে তার অতিসাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হলো, করোনা পরিস্থিতিতে মসজিদে জামাতে জনসমাগম নিয়ে উলামাদের মাঝে সৃষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্ব। এছাড়াও নির্বাচন, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়েও যে প্রায়শই জায়েজ-নাজায়েজের কথা শোনা যায় সেটাও এই সমস্যা থেকে নির্গত। সমাজবিজ্ঞানের সবকিছুকে আইনের মাপকাঠি দিয়ে মাপা।

ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রের এই একমাত্র আইনকেন্দ্রীক পড়াশোনার ক্ষতি বহুমাত্রিক। সেজন্য যতদ্রুত সম্ভব ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে আইন শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক বিজ্ঞানের অন্য বিষয়গুলোতেও প্রতিষ্ঠানিক পাঠদান ও গবেষণা জরুরি। তাহলেই সমাজের নিত্যদিনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা সম্ভব হবে। ইসলাম একটি পুর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা এই দাবীর যথার্থতা প্রমানিত হবে। ইনশাআল্লাহ।

(এই মতামত একান্তই আমার নিজের। ইসলামী জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রে প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনা করা এবং দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি দীর্ঘদিন বাংলাদেশের মাঠে-ঘাটে ও মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সক্রিয় ইসলামী রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা এবং বহুমাত্রিক ইসলামী সাহিত্য অধ্যায়নের ফলে আমার এই ধারনা জন্ম নিয়েছে।
আমি যে রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক ধারার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে গৌরববোধ করি এই ধারনার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নাই। এই মতামত একান্তই আমার। এর দায়িত্বও আমার।
আমি জানি, আমার এই মতামতের সাথে অনেকেই একমত হবেন না। সেটা হওয়াও জরুরি না। জরুরি হলো, বিষয়টা পর্যালোচনা হওয়া। সেই লক্ষেই লেখাটা তৈরি করা।
বি.দ্র. আমাকে বারংবার এই ধরনের ভূমিকা লিখতে হচ্ছে। কারণ আমি কিছুকাল আমার অনুসৃত ধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলাম। সেকারণে কেউ কেউ আমার মতামতকে সেই রাজনৈতিক ধারার বক্তব্য বলে বিবেচনা করেন।

বিষয়টা আমি আগেও বলেছি, ফেসবুকের ওয়ালে সাধারণ পোস্ট আকারে আমি কখনোই দলীয় বক্তব্য প্রকাশ করি না। দলীয় বক্তব্য প্রকাশের নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি মেনেই প্রকাশ করা হতো।
আর এখন আমি গুরুত্বপূর্ণ কোন দায়িত্বে নাই। দলীয় মতামত প্রকাশের দায়িত্বে এখন তো নাই-ই অতিতেও কখনো ছিলাম না।
তাই দয়া করে আমার কোন মতামতের সাথে আমার অনুসৃত ধারাকে সম্পৃক্ত করলে সেটা তার বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ হবে মাত্র।)

বি.দ্র.এই লেখা ইসলামী আইন নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণার বিপক্ষে নয়। বরং এর পাশাপাশি অন্য বিষয়গুলোকেো অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে।

লেখক: শেখ ফজলুল করিম মারুফ
সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, ইসলামী শাসনতন্ত ছাত্র আন্দোলন


source https://deshdunianews.com/%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87-%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%80-%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%9e%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%9a%e0%a6%b0/

0 Comments