কার ফতোয়ায় কে কাঠমোল্লা? – মুফতি আবদুর রহমান গিলমান

দেশ দুনিয়া নিউজ
কার ফতোয়ায় কে কাঠমোল্লা? – মুফতি আবদুর রহমান গিলমান

দেশ দুনিয়া নিউজ ডেস্ক: সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। সাবেক সাংসদ, আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে যোগদানকারী জামায়াতীভাবাপন্ন লেখক, জনাব গোলাম মাওলা রনির একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদে ইতোমধ্যে অনলাইনে তুমুল ঝড় উঠেছে। ভিডিওটিতে রনি সাহেব সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত-সমালোচিত একজন বক্তাকে হাইলাইটস করে এদেশের হক্কানী উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন চরমভাবে। এদেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় উলামায়ে কেরামকে হেয়প্রতিপন্ন করে প্রায় ১৭ বার তিনি ‘কাঠমোল্লা’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন।

রনি সাহেবের পুরো বক্তব্যের জবাব দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। ইতোমধ্যে অনেকেই তার জবাব লিখেছেন। বিশেষ করে দেশ দুনিয়া নিউজ সম্পাদক মাওলানা আবদুর রাজ্জাক সাহেব আমার জানা মতে সর্বপ্রথম এ বিষয়ে কলম ধরেছেন। আমি রনি সাহেবের ব্যক্তি জীবনের কোন বিষয়- যেমন সাংবাদিক পিটিয়ে জেলে যাওয়া ইত্যাদি নিয়েও লিখছি না। সংক্ষেপে রনি সাহেবের বারবার উচ্চারিত কাঠমোল্লা শব্দ নিয়ে দু’একটি কথা বলতে চাই।

কাঠমোল্লার মধ্যে দুটি শব্দ রয়েছে। কাঠ এবং মোল্লা। প্রথমে আসুন মোল্লা কাকে বলে জেনে নিই। মোল্লা আরবি অথবা ফারসি শব্দ। যার অর্থ পরিপূর্ণ জ্ঞান বিশিষ্ট মহাপন্ডিত ব্যক্তি। যেমন মোল্লা জামী, মোল্লা আলী কারী, মোল্লা আহমদ জীওন ইত্যাদি। একটি সময়ে মোল্লা শব্দটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রদত্ত সম্মানসূচক উপাধি ছিল। যেমন, মোল্লা বিহারী।

মোল্লা শব্দটি বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন মুসলিম দেশের মুসলমানদের পদবী রূপে ব্যবহার হয়ে আসছে। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো যারা আঁকড়ে ধরেন, চর্চা বা পালন করেন তাদেরকে মোল্লা বলে। কেউ কেউ মোল্লা শব্দের বিশ্লেষণ করেছেন- মূল> মৌলিক> মোল্লা। তার মানে, যারা ইসলাম ধর্মের মূল এর ওপর আছেন তারা মোল্লা।
উপরে বর্ণিত অর্থে মোল্লা একটি সম্মানসূচক শব্দ। গভীর জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিদেরকে মোল্লা বলা হয়। এই অর্থে বাংলাদেশের হক্কানী ওলামায়ে কেরাম সবাই মোল্লা। তাঁরা মোল্লা আলী কারী, মোল্লা বিহারী, মোল্লা জামি ও মোল্লা জীওনের মত যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের রচিত কিতাব পড়ে তাঁদের মতো মোল্লা হয়েছেন।

মোল্লা শব্দটির উৎপত্তি এবং প্রাথমিক প্রচলন একটি ব্যাপক অর্থে হলেও পরবর্তীতে শব্দটি তার ব্যাপকতা হারায়। শব্দটির মাঝে যে ভাবগাম্ভীর্যতা ছিল তা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। একটি পর্যায়ে এসে মসজিদের নামাজ পরিচালনাকারী মাত্রই মোল্লা নামে অভিহিত হতে থাকে। যেহেতু তারা পূর্বেকার জ্ঞানী মোল্লাদের মতো আলেম নন এবং দীনের বহুমুখী খেদমতেও তারা নিয়োজিত নন, এজন্য তাদের থেকেই ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ প্রবাদের উৎপত্তি হয়েছে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন মোল্লার নাম শোনা যায়। যেমন, কাদের মোল্লা, মোল্লা নাজিম ইত্যাদি। তারা কী অর্থে মোল্লা তা ঠিক আমার জানা নেই।
অভিধানে মোল্লার আরেকটি পরিচয় হলো মোল্লা একটি বংশীয় উপাধি বিশেষ।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা মোটাদাগে মোল্লার দুটি অর্থ পেলাম।

(এক.) বড় আলেম যারা ইসলামের সর্ব বিষয়ে চিন্তা করেন।
(দুই.) ছোট আলেম যারা মসজিদ বা ছোট্ট পরিসরে দীনের কোন খেদমতে নিয়োজিত।
এবার আসুন কাঠমোল্লা কাকে বলে? মোল্লা মানে তো আলেম। এখন তার শুরুতে কাঠ যুক্ত হয়েছে। তাই আমাদেরকে দেখতে হবে কাঠ মানে কী?

বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক অভিধানে কাঠের বেশকয়েকটি অর্থ লিখেছে- ১. কাষ্ঠ, ২. কঙ্কাল বা হাড়, ৩. রসশূন্য, ৪. নিস্তব্ধ, ৫. শক্ত বা অসাড় ইত্যাদি। অর্থাৎ কাঠ বলা হয় প্রাণহীন বৃক্ষকে। যে বৃক্ষ প্রচুর ফল দিত, কিন্তু প্রাণহীন হওয়ার কারণে তাকে কাষ্ঠ বলা হয়। তার মাঝে আর কোন ফল হয় না। তাহলে কাঠ মানে আমরা পেলাম- প্রাণহীন বস্তু। এখন কাঠমোল্লার অর্থ দাঁড়ালো প্রাণহীন আলেম। প্রাণহীন আলেম বলতে কি আসলে কিছু আছে? হ্যাঁ অবশ্যই আছে। আরবি একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদ বাক্য রয়েছে– العالم بلا عمل كشجر بلا ثمر
অর্থাৎ আমলবিহীন আলেম ফলবিহীন বৃক্ষের ন্যায়। বাহ কী চমৎকার মিল! যে আলেমের নিকট ইলম আছে কিন্তু তদানুযায়ী আমল নেই, তিনি ফলবিহীন বৃক্ষের ন্যায়, মানে কাঠের ন্যায়। অর্থাৎ আমলবিহীন আলেম‌ই কাঠমোল্লা। যে আলেমের কাছে পর্দার ইলম আছে, সুন্নতের ইলম আছে, দাড়ির ইলম আছে, মাযহাব মানা আবশ্যক এর ইলম আছে, তাগুতের সাথে ঐক্যের কুফল এর জ্ঞান আছে, কিন্তু সে অনুযায়ী আমল নেই, তিনিই কাঠমোল্লা।
এবার আসুন হাদিস থেকে একটু আলোচনা করি। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَثَلُ الَّذِي يَذْكُرُ رَبَّهُ وَالَّذِي لا يَذْكُرُ رَبَّهُ مَثَلُ الحَيِّ وَالمَيِّتِ
সহিহ বুখারী হাদিস নং- ৬৪০৭
অর্থাৎ, যিনি জিকির করেন আর যিনি জিকির করেন না তাদের দৃষ্টান্ত জীবিত ও মৃতের ন্যায়। (যিনি জিকির করেন তিনি জীবিত আর যিনি করেন না তিনি মৃত।) সুতরাং, যে আলেম জিকির করেন তিনি প্রাণবন্ত মোল্লা, আর যে আলেম জিকির করেন না তিনি মৃত মোল্লা মানে কাঠমোল্লা।

একজনে কাঠমোল্লার সুন্দর একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। ‘যারা ইসলামের ভেতর থেকে ইসলামের কিছুটা এবং শয়তানের ওয়াসওয়াসা সম্বলিত নফসের কিছুটা নিয়ে একটি প্যাকেজ তৈরি করে জনগণকে সেটা খাওয়ানোর ব্যাপারে অনড়, কাঠের মতো শক্ত, তারাই কাঠমোল্লা।’

আমরা দেখেছি, কিছুদিন পূর্বে একজন বক্তা পর্দাসহ বেশ কিছু ইসলামের বিধান সম্পর্কে নিজের মনগড়া বক্তব্য দিয়ে জনগণকে তা গ্রহণ করাতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। সমস্ত উলামায়ে কিরাম তার ভুল ধরিয়ে দিলেও তিনি সংশোধন হননি। বরং তিনি তার মতের ওপর কাঠের মত অটল ছিলেন।

প্রিয় পাঠক! আমার এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার পর রনি সাহেবের বক্তব্যের প্রতি একটু খেয়াল করুন। তিনি সমকালীন আলোচিত-সমালোচিত নিছক এক বক্তাকে মহাজ্ঞানী বলেছেন। আর দেশের নির্ভরযোগ্য, আমলওয়ালা, জাকিরিন আলেমদেরকে কাঠমোল্লা বলেছেন। আপনারা আশা করি বুঝতে পেরেছেন, আসলে কার ফতোয়ায় কে কাঠমোল্লা হলো!
ইলম অনুযায়ী আমল এবং জাকিরিন হিসেবে আলোচিত সেই বক্তা অগ্রগামী না দেশের বিদগ্ধ ওলামায়ে কেরামগণ? তিনি যাকে মহাজ্ঞানী বলেছেন, তারা তো জিকির করা দূরে থাক, বরং অন্য জাকিরিনদেরকে জিকির থেকে দূরে সরানোর জন্য বিভিন্ন ফতোয়াবাজি করে থাকেন।

আমি আসলে রনি সাহেবকে কিছুটা জ্ঞানী মনে করতাম। তার প্রবন্ধগুলো পড়তাম। কিন্তু তিনি যে বক্তা আর আলেমের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করতে জানেন না- এটা কে জানে!

লেখক: মুফতি আবদুর রহমান গিলমান
পরিচালক, জামিয়া কুরআনিয়া, ফুলগাজী, ফেনী
সদর, বামুক ফেনী জেলা

আরো পড়ুন: করোনা থেকে মুক্তির কুরআনী ওষুধ -মুফতি আবদুর রহমান গিলমান

কার ফতোয়ায় কে কাঠমোল্লা? – মুফতি আবদুর রহমান গিলমান
deshdunianews



source https://deshdunianews.com/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%ab%e0%a6%a4%e0%a7%8b%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%95%e0%a7%87-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%a0%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%b2/

0 Comments