ইসলাম ও বাঙ্গালীয়ানা পর্ব-১ : শেখ ফজলুল করীম মারুফ

  • দেশ দুনিয়া নিউজ ডেস্ক

ইসলাম ও বাঙালিয়ানাকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে।

শেখ ফজলুল করীম মারুফ 

সভ্যতার সংঘাত তত্ত্বে “বিভ্রান্ত রাষ্ট্র” বলে একটা ধারনা আছে। বিভ্রান্ত রাষ্ট্র হলো সেগুলো, যাদের সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী ধর্মীয়-সংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং পরিচয় আছে একই সাথে সেই ধর্মীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধেও প্রবল ধারনা আছে।

এই “বিভ্রান্ত রাষ্ট্রগুলো” সভ্যতার সংকটের সবচেয়ে নির্মম পরিনতির শিকার হয়। দেশের জনমত দুইভাবে বিভক্ত থাকে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে না, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন হয় না এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের কোন সত্যিকার বন্ধু থাকে না।

স্যামুয়েল পি হান্টিংটন বিভ্রান্ত রাষ্ট্রের উদহারন হিসেবে তুরস্কের কথা উল্লেখ করেছেন। ৯০ এর দশকের মাঝামাঝিতে যখন তিনি বইটি লেখেন তখন তুরস্ক বিভ্রান্ত রাষ্ট্রই ছিলো। এখনকার তুরস্ক তা না। ফলে তুরস্ককে দিয়ে বিভ্রান্ত রাষ্ট্র ধারনা বোঝা কঠিন।

সেজন্য হালআমলের বিভ্রান্ত রাষ্ট্র মিশরের উদাহরণ পাঠককে ধারনাটি বুঝতে সাহায্য করবে।

মিশরের একটি দীর্ঘ ইসলামী ঐতিহ্য আছে। ইসলামের প্রথম শতকেই মিশর ইসলামের সংস্পর্শে আসে এবং পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে মিশর জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, রাজনীতি ও সামরিক শক্তিতে এবং ক্রুসেডের ক্ষেত্র হিসেবে ইসলামের কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। মিশরের প্রতিটি বালুকনায় ইসলামের ইতিহাস, ঐহিত্য মিশ্রিত। একই সাথে মিশরে সেক্যুলারিজম, ইসলামমুক্ত আরব জাতীয়তাবাদ, ভোগবাদী বস্তুবাদ ও ইসলামের রাজনৈতিক ধারনা বিরোধী প্রবল জনমতও বিদ্যমান। এই পরস্পর বিরোধী অবস্থার কারণে মিশর সভ্যতার সংঘাতে একটি বিভ্রান্ত রাষ্ট্র। সভ্যতার সংঘাতে মিশর না ইসলামী বলয়ে না ইসলামবিরোধী বলয়ে। এই অবস্থাকেই সভ্যতার সংকট তত্ত্বে “বিভ্রান্ত রাষ্ট্র বলা হয়।

বিভ্রান্ত রাষ্ট্র হওয়ার ফলে মিশর কি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা নতুন করে বলার নাই। এতো বিপুল পরিমান রক্তের নজরানা পেশের পরেও মিশর আজো স্বৈরাচারী শাসকের কব্জায়, সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নাই, অর্থনীতি দুর্বল, সামাজিক বিভেদ চুড়ান্ত পর্যায়ে। সব মিলিয়ে মিশর অমিত সম্ভবনাময় হওয়া সত্যেও কেবল আদর্শিক বিভ্রান্তির কারণে আজ প্রায় ভঙ্গুর একটি রাষ্ট্র। বিভ্রান্ত রাষ্ট্রের এই পরিনতি প্রায় আবশ্যম্ভাবি।

লক্ষনীয় বিষয় হলো, সবগুলো বিভ্রান্ত রাষ্ট্রই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ।

মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে বিভ্রান্ত করতে পশ্চিমের অরিয়েন্টালিষ্টরা বহু বছর ধরে কাজ কাজ করেছে। তারা মুসলিম জাতীয়তা এবং ভাষাভিত্তিক বা আঞ্চলিক জাতীয়তাকে মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়েছে, যেমন আরব জাতীয়তাবাদকে ইসলামের বিরুদ্ধে দাড় করিয়েছে।

স্বাধীনতা, মুক্তি, অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে ভিত্তিহীন ও নড়বড়ে সংজ্ঞা দাড় করিয়ে সেগুলোকে পণ্যের মতো মার্কেটিং করে ইসলামের মৌলিক ধারনার মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়েছে। বারংবার বলে বলে ইসলামকে হীনতর ও পশ্চিমকে শ্রেষ্ঠ বলে সাবস্ত করে ফেলেছে। মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা বদলে দিয়েছে, শিক্ষকদেরকে পশ্চিমে স্কলারশিপ দিয়ে নিয়ে গিয়ে পশ্চিমা অখাদ্যকে সুস্বাদু করে মগজে গ্রোথিত করে দিয়েছে, এনজিও করে পশ্চিমা ধারনা সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে পৌছে দিয়েছে। আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে পশ্চিমা উচ্ছৃঙ্খল জীবনকে আদর্শ বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে, ভোগবাদীতাকে সাফল্য বলে তুলে ধরেছে।

পশ্চিমাদের এইসব বহুমাত্রিক আগ্রাশনে মুসলিম সমাজগুলো চূড়ান্তভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পরেছে। যার প্রভাব পরেছে রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্বত্র।

মুসলিম সমাজকে বিভ্রান্ত করার এই সর্বগ্রাসী প্রলয় মোকাবিলায় মুসলিম নেতৃবৃন্দের ভুল ছিলো। এই প্রলয় মুসলিম উম্মাহের ওপরে এসেছে এমন সময়ে যখন মুসলিম উম্মাহ তার দর্শন, আধ্যাতিকতা, নৈতিকতা ও তাকওয়া পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে। যখন ইজতেহাদের দরজা রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে এই প্রলয় মোকাবিলায় মুসলিম উম্মাহ ভুল করবে এটা পূর্বানুমিত ছিলো।

মুসলিম উম্মাহের ওপরে এর আগেও ভয়ংকর সব প্রলয় এসেছে। তাতারি ও ক্রুসেডের প্রলয়। কিন্তু তখন উম্মাহ তার অন্তর্নিহিত শক্তির কিছুটা ধারন করতো বলে সেসব প্রলয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলো। কিন্তু আধুনিক পশ্চিমের প্রলয় মোকাবিলায় তারা ভুল করেছে। একদল চোখ বন্ধ করে এই প্রলয় এড়াতে চেয়েছে আরেকদল এই প্রলয়ের শক্তিকে তুচ্ছ করে দেখে সরাসরি এর মোকাবিলা করতে গিয়েছে।

এই ভুলের মাশুল কত নির্মমভাবে মুসলিম উম্মাহকে দিতে হয়েছে তার রাজনৈতিক চিত্র হলো, এক পর্যায়ে গোটা বিশ্বের প্রত্যেকটি মুসলিম জনপদকে পশ্চিমা পদানত করে নেয়। প্রথম কেবলা হাতছাড়া হয়ে যায়, খিলাফত বিলুপ্ত হয়ে যায়। এমনকি ইসলামের রাজনৈতিক ধারনার তাত্ত্বিক অস্তিত্ব পর্যন্ত মুছে যায়।

এর সামাজিক পরিনতি সম্পর্কে সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রঃ “ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব” বইয়ে খুবই করুণ চিত্র একেঁছেন।

আমরা এদেশ বাসীও এর কিছুটা জানি। ৭০০ বছরের শাসক একটি জাতি রাতারাতি ফকিরে পরিনত হয়েছিলো। ধনে-জ্ঞানে সমৃদ্ধ এই জাতি ১৩৫০ বাংলা সনে ইতিহাসের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে পথে-ঘাটে মরেছে।

পশ্চিমা আগ্রাশনে জাতিকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা এখনো চলমান এবং বিস্ময়করভাবে মুসলিম উম্মাহের ধর্মীয় এখনো সেই একই রকম ভুল করে চলেছে।

মুসলিম রাষ্ট্রকে বিভ্রান্ত করার ক্ষেত্রে ওদের প্রথম ও প্রধান অস্ত্র হলো, ইসলাম এবং ভাষাভিত্তিক, নৃতাত্ত্বিক ও আঞ্চলিক জাতীয়তাকে মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়া।
আরবে ওরা এই কাজ করেছে।

বাংলাদেশেও ওদের দ্বারা মগজধোলাইকৃত একদল বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাকে ইসলামের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশকেও একটি বিভ্রান্ত রাষ্ট্রে পরিনত করার অপচেষ্টা করছে। ইতিহাস বিকৃতি করে, বাংলা সংস্কৃতির নামে ভিন্ন আদর্শিক সংস্কৃতির প্রচলন ঘটিয়ে এই কাজটা করছে। এই কাজে পশ্চিমাদের সহযোগি হিসেবে ইসলামপন্থীরাও যোগ দিয়েছে।

বাংলাদেশকে বিভ্রান্ত রাষ্ট্রে পরিনত করার ক্ষেত্রে ওরা অনেকখানি সফল হয়েছে। এর ফলে সমাজে যে ভয়ংকর অস্থিরতা দেখা দিয়েছে তার কিয়দংশ প্রকাশ পায় পরকীয়া, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার নৃশংসতা, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের উদাসিনতা, যুব সমাজের মাদক ও অশ্লীলতার মাঝে ডুবে যাওয়া, উগ্রতার প্রসারের মাধ্যমে।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশকে বিভ্রান্ত রাষ্ট্রে পরিনত হওয়া থেকে রক্ষা করার উপায় কি?

উপায় হলো, বাঙ্গালীয়ানা ও ইসলামকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সাব্যস্ত করা। ইসলামকে বাঙ্গালীর ঐহিত্য এবং বাঙ্গালীয়ানাকে ইসলামের অংশ হিসেবে তুলে ধরা৷ ইসলাম ও বাঙ্গালীয়ানার মাঝে কোন বৈপরিত্য থাকলে সেটাকে এড়িয়ে যাওয়া। এবং ইতিহাস থেকে এই দুইটিকে অবিচ্ছেদ্য আকারে উপস্থাপন করা।

তুরস্কে একেপি এই কাজটাকে খুব চমৎকার ভাবে করেছে। তুর্কি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামকে অবিচ্ছেদ্য আকারে উপস্থাপন করেছে এবং সেটা সাব্যস্তও করে ফেলেছে। তুর্কি সিরিয়ালগুলোতেও একই বার্তা দেয়া হচ্ছে। এটা করে ফেলার কারণে সেক্যুলার দলগুলোও অজান্তে ইসলামের পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য হচ্ছে। আয়া সোফিয়া নিয়ে ইস্তাম্বুলের কামালিস্ট পার্টির মেয়রও সমর্থন জানিয়েছেন। কারণ এটাকে জাতীয় ইস্যু বানিয়ে ফেলেছে একেপি।

বাংলাদেশেও যদি ইসলামপন্থীরা সফল হতে চায় তাহলে তাদেরকেও একই কাজ করতে হবে। ইসলাম ও বাঙ্গালীয়ানাকে একে অপরের পরিপূরক আকারে উপস্থাপন করতে হবে।

কাজটা কঠিন তবে অসম্ভব না। এজন্য প্রথম যা দরকার তাহলো, ইসলামপন্থীদের নিজেদেরকে বাঙ্গালী সংস্কৃতির একনিষ্ট বলে প্রমান করতে হবে। এই যাত্রায় প্রাথমিক ভাবে এমন কিছু করতে হতে পারে যা ইসলামপন্থার সাথে যায় না। কিন্তু সেটা করতে হবে বাঙ্গালী সংস্কৃতির প্রতি একনিষ্টতা প্রমান করার জন্য। একেপি প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিলো তুরস্ককে ইউরোপিয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দিয়ে। এরপরে তুরস্ক দীর্ঘ পথচলায় তুর্কি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামের মাঝে যে বৈপরীত্যে ছিলো তা একে একে দুর করেছে।

বাংলাদেশেও একই কাজ করতে হবে। যদি এটা করা যায় তাহলে বাংলাদেশের ইসলামপন্থার জন্যও সেটা ভালে এবং বাংলাদেশের জন্যও সেটা ভালো হবে।

অন্যথায় বাংলাদেশে ইসলামপন্থা মিশরের মতো স্থায়ীভাবে আটকে যাবে একই সাথে বাংলাদেশও অর্থনৈতিক, সামাজিক সংস্কৃতিক ও সামরিকভাবে পিছিয়ে থাকবে।

লেখক ও রাজনীতি গবেষক



source https://desh-duniyanews.com/%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae-%e0%a6%93-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%99%e0%a7%8d%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%80%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d/

0 Comments