আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ. শিল্পী নয়; তিনি একজন বিপ্লবী

ফয়জুল করিম:

মাওলানা আইনুদ্দীন আলআজাদ রাহ. ছিলেন ইসলামী রাজনীতি ও সংস্কৃতির অঙ্গনের একজন উদ্যমী ব্যক্তি। সুললিত কণ্ঠে তিনি যেমন শোনাতেন ইসলামের সাম্য ও আদর্শের বাণী তেমনি তুলে ধরতেন সমাজের নানা অবিচার ও অসঙ্গতি। বাতিল ও অপসংস্কৃতির মোকাবেলায় সুস্থ ও নির্মল সংস্কৃতির বিকাশের লক্ষ্যে তিনি নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন। কিশোর ও যুবসমাজকে পাশ্চাত্যের উৎকট সংস্কৃতি থেকে রক্ষার জন্য গড়ে তুলেছিলেন মননশীল এক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘কলরব’।

রাজনৈতিক অঙ্গনেও তাঁর পদচারণা ছিল। ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ -এর ঢাকা মহানগরীর সহসভাপতির পদে তিনি দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই উদ্যমী মানুষটি হঠাৎ করেই আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। গত ১৮ জুন ২০১০ ঈ. (৫ রজব, ১৪৩১ হি.) রোজ শুক্রবার নাটোরের লালপুরে তিনি এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

জন্ম ও পড়াশোনা : ১৯৭৩ সনে খুলনার ঝিনাইদহ উপজেলার হাজরাতলা গ্রামের এক ভদ্র পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের মকতবে তাঁর পড়ালেখা শুরু হয়। এরপর স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং পরে ঝিনাইদহ শহরের কাস্টসাগরা দাখিল মাদরাসায় পড়াশোনা করেন। আলিম ও ফাজিল সমাপ্ত করেন ছারছীনা মাদরাসায়। এরপর ঢাকা আলিয়া থেকে কামিল পাশ করেন। সবশেষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা-সাহিত্যে অনার্স করেন।

কর্মজীবন : মাওলানা আজাদ এর আধ্যাত্মিক রাহবার ছিলেন চরমোনাইর পীর মরহুম সৈয়দ ফজলুল করীম রাহ.। পীর সাহেব হুজুরের সাথে সম্পর্কের ফলে তিনি ইসলামী রাজনীতিতে যুক্ত হন ৷ উদ্যম ও বিশ্বাসের কারণে অল্পদিনেই দলের সবার কাছে প্রিয় ও আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন।

দেশব্যাপী অপসংস্কৃতির সয়লাব এবং কিশোর ও তরুণসমাজের অবক্ষয় রোধে তিনি কাজ শুরু করেন। গান, বাদ্য ও উদ্দাম নৃত্য-গীতের মোকাবেলায় তিনি শুদ্ধ ও নির্মল গজল-সঙ্গীত পরিবেশন করতে শুরু করেন। পাশাপাশি ওয়াজ-নসীহত, বক্তৃতাও করতে থাকেন। তাঁর সুরে ও কথায় অসংখ্য মানুষ মুগ্ধ হয় এবং দেশে-বিদেশে তার অনেক ভক্ত তৈরি হয়। হাজারো মানুুষের ভক্তি ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে পূর্ণ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন।

তৃণমূল পর্যায়ে সুস্থ সাংস্কৃতিক ভিত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২৮ মে ২০০৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কলরব’, যাতে সারা দেশের প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ দিবসসহ বিভিন্ন সময় তিনি বিকল্প অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তাঁর মোট ২২টি ইসলামী সঙ্গীতের ক্যাসেট বের হয়েছে। এছাড়া গ্রাফিক্স, ডিজাইন ও প্রচ্ছদ তৈরি ইত্যাদি কাজও তিনি করতেন।

আমল-আখলাক : নামাযের বিষয়ে তিনি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। সফরে তাঁকে অনেক সময় কাটাতে হত। তা সত্ত্বেও নামায যাতে না ছুটে সেদিকে খেয়াল রাখতেন। অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছে নামায পড়তে বিলম্ব হবে, বলে গাড়ি থামিয়ে নামায পড়তেন অনেক সময়।

তিনি ছিলেন সদাহাস্যময়। অপরিচিতকে আপন করে নিতে তাঁর বিলম্ব হত না। তাঁর মাঝে একরাম ও এহসানের গুণ ছিল চোখে পড়ার মতো। অন্যের উপকারের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। বিশেষত শিশু-কিশোর ও নবীনদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। অজপাড়াগাঁয়ের অনেক ছেলেকে নিজ খরচে ঢাকায় এনে তাদের প্রতিভার পরিচর্যা করেছেন। কেউ সমস্যায় পড়লে স্বেচ্ছায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন।

এ রকম এক ঘটনায় তিনি শিল্পী আবু রায়হান ও তার ভাইকে নিজের বাসায় নিয়ে মেহমানদারি করেন ও তাদের সার্বিক অবস্থা শুনেন। পরে নিজ তত্ত্বাবধানে রেখে তাদের শিল্পী হওয়ার পিছনে মূল ভূমিকা পালন করেন। লেবাস-পোশাকে ও বেশ-ভূষায় সব সময়ই সুন্নতের ইত্তেবা করতেন। পাগড়ি, লম্বা জামা, শ্মশ্রুশোভিত বদনে তাকে মর্দে মুমিনের মতো দেখাত। সঙ্গী ও সহকর্মীদেরকেও ইত্তেবায়ে সুন্নতের অনুসরণের তাগিদ দিতেন। দ্বীনের খেদমতের প্রেরণা তাঁর মধ্যে জাগ্রত থাকত। একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘এ অঙ্গনে আমার দ্বারা যদি দ্বীনের কোনো ক্ষতি হয় কিংবা আমি যদি ইসলামের বিরুদ্ধে চলি তাহলে আল্লাহ যেন এর পূর্বেই আমার কণ্ঠ নষ্ট করে দেন।

পারিবারিক জীবন : আইনুদ্দীন আলআজাদ রাহ.-এর মা-বাবা জীবিত আছেন। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পিতামাতার পঞ্চম সন্তান। স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা রেখে গেছেন।

মাওলানা আজাদ রহ.ই ছিলেন তাঁর পরিবারের দ্বীনি ধারায় পড়াশোনা করা একমাত্র ব্যক্তি। ফলে মা-বাবার প্রতি তিনিই বেশি যত্নবান ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালে তাঁর মা-বাবাই সবচে’ বেশি শোকাহত হয়েছেন। তাঁর বাবা বলেন, ‘‘আজাদ থাকতে আমার কোনো চিন্তা ছিল না। এখন তাঁর মতো করে কে আমাদের খোঁজ-খবর নেবে ?

তাঁর স্ত্রীর অভিব্যক্তি: ‘‘এতিম ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। চেষ্টা করব-ওদের বাবার স্বপ্ন অনুযায়ী ওদেরকে ইলমে দ্বীন শেখাতে। ‘‘দ্বীনি খিদমতের বিষয়ে তাঁর অনেক ইচ্ছা ও স্বপ্ন ছিল। নিজ গ্রামে একটি দ্বীনী মাদরাসা ও একটি বড় মসজিদ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জীবদ্দশায় করে যেতে পারেননি।

বেদনার্ত অভিব্যক্তি: ইসলামী আন্দোলনের আমীর, পীর সাহেব চরমোনাই, সৈয়দ রেজাউল করীম দা.বা. তাঁর অভিব্যক্তিতে বলেছেন, ‘‘মাওলানা আজাদ একজন ত্যাগী কর্মী ছিলেন এবং সারাদেশে গজলে গজলে যে খিদমত তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।’’

শেষকথা
সাহাবী হযরত সালমান ফারসী রা. বলেছেন, ‘কোনো ভূখণ্ড কাউকে শ্রেষ্ঠ বানাতে পারে না। একমাত্র আমলই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে।’ আমরা আশা করি, মাওলানা আজাদ রাহ. তাঁর জীবনের স্বল্প পরিসরে দ্বীনী খেদমতের যে চেষ্টা করে গেছেন তাই তাকে মর্যাদা দান করবে।

আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন এবং তাঁর এতীম সন্তানদের সুবন্দোবস্ত করুন। আমীন।



source https://deshdunianews.com/%e0%a6%86%e0%a6%87%e0%a6%a8%e0%a7%81%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%80%e0%a6%a8-%e0%a6%86%e0%a6%b2-%e0%a6%86%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%a6-%e0%a6%b0%e0%a6%b9-%e0%a6%b6%e0%a6%bf%e0%a6%b2%e0%a7%8d/

0 Comments