ব্যবসায় আলেম সমাজ; কিছু পরামর্শ: সৈয়দ শামছুল হুদা

দেশ দুনিয়া নিউজ ডেস্কঃ করোনা ভাইরাস অনেক কষ্ট ও বেদনা বয়ে আনলেও দেশের আলেম সমাজকে বাস্তবটা উপলব্দি করার সুযোগ করে দিয়েছে। আয়ের উৎস হিসেবে এতদিন যেগুলোকে খুব নিরাপদ ভাবতাম, সেগুলো আজ ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠায় বিকল্প ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। এতদিন এসব নিয়ে যারা কাজ করতো, যারা কথা বলতো, তাদের অনেকেই বাঁকা চোখে দেখতেন। এখন আর সেটা দেখা হচ্ছে না। বিশ্ব পরিস্থিতি এবং দেশীয় কূটচাল আমাদেরকে ভাবতে বাধ্য করছে যে, এক ঘাটকে সবার আয়ের উৎস বানানো যাবে না। এটা নিরাপদ না। নিশ্চিতও না।

কওমী মাদ্রাসাসমূহ গত কয়েক বছর যাবত কোরবানীর চামড়া থেকে যে আয় আসতো সেটা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এটা খুব পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। বিশেষকরে গত বছর কোরবানীর চামড়া নিয়ে যা করা হয়েছে তা  এক কথায় অকল্পনীয়। আর এ বছর গোটা রমযান মাস লকডাউন থাকায় মাদ্রাসার মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম। সামনে আবারো আসছে কোরবানী। সেখান থেকেও যে খুব একটা আয় আসবে না, সেটা এখনই আঁচ করা যাচ্ছে। পরপর কয়েকবছর কোরবানী আয় থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর রমযান মাসের বড় ধরণের যে আয় হয় সেটা থেকেও বঞ্চিত হওয়ার মাধ্যমে কওমী মাদ্রাসার আলেমদের সামনে আর্থিক বড় ধরণের সংকট নিয়ে এসেছে।

এই বাস্তবতা থেকে এবং লকডাউনের দীর্ঘ ছুটিতে অনেক তরুন আলেমদের মধ্যে ব্যবসাবান্ধব জীবন গঠনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। দেশে হাজারো পদের ব্যবসা আছে। ছোট, মাঝারি ও ভারি শিল্পের ব্যবসা আছে। প্রাথমিকভাবে একেবারে ব্যবসার হাতেখড়ি অর্জনের জন্য অনেক তরুন আলেম কেউ সরিষার তৈল উৎপাদন, কেউ কালো জিরার তেল উৎপাদন, কেউ মাস্ক, পিপিই ইত্যাদি স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সামগ্রী সরবরাহ ও বিক্রি, কেউ মধু মার্কেটিং, কেউ মৌসুমী ফল, কেউ বা  পশু পালন, কেউ বা কৃষি উৎপাদনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে এসেছেন। এর মাধ্যমে বাস্তবতা চ্যালেঞ্জ করা শিখছেন। নবীন আলেমগণ এসব করে ভালো আনন্দ পাচ্ছেন।

এর মাধ্যমে ব্যবসার হাকীকত বুঝে আসছে। অনেকে ফেসবুকে স্টেটাস দিয়ে জানাচ্ছেন আজকে আমার এই ব্যবসা করে ১৫০০/২০০০ টাকা আয় হয়েছে। অর্থাৎ বুঝতে পারতেছেন যে, শুধু মসজিদ ও মাদ্রাসায় অনেক সময় অপমানের জিন্দেগী যাপন করতে হয় মাস শেষে ১০,০০০/- টাকা আয়ের জন্য। অথচ ছোটখাটো একটা ব্যবসা করেও প্রতিদিন ৭শ/৮শ টাকা আয় করা সম্ভব। হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। একজন সাধারণ ভ্যানচালক সেও প্রতিদিন গড়ে ১হাজার টাকা আয় করে। তার মানে মাস শেষে তার ৩০হাজার টাকা আয়। একজন তরকারী বিক্রেতাও প্রতিদিন গড়ে এ পরিমান  আয় করে। তারও মাস শেষে ৩০/৩২হাজার টাকা আয় হয়। তাহলে আমরা কেন গোলামীর জিন্দেগী যাপন করবো? কেন আমরা মুর্খ, গোয়ার, অশিক্ষিত, সুদখোর, ঘুষখোর কমিটির ধমক শুনেও মাথা ‍ নুইয়ে পড়ে থাকবো? কেন কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবো না? কেন মুহতামিমদের দিনের পর দিন জুলুম সহ্য করে যাবো? এসব ভেবে দেখার সময় এসেছে।আমাদের সবার সামনে যদি বিকল্প আয়ের পথ থাকে তাহলে কেউ ধমক দিয়ে কথা বলতে পারবে না।

নতুন এই ময়দানে কাজ করতে আসা তরুন আলেমদের প্রতি আমার কিছু পরামর্শ থাকবে।

১। আপনি যা না তা প্রকাশ করবেন না।
অনেককেই এমনটা করতে দেখি যে, আপনি যে পর্যায়ের না, সে জায়গাটায় নিজেকে ব্যবসায় হাত দিয়েেই ভাবতে থাকেন। নিজেকে খুব বড় মনে করা শুরু করেন। একটা অহঙ্কারী ভাব চলে আসে। এটা খুব ক্ষতিকর। ব্যবসা করতে আসছেন। ধীরে ধীরে আগান। শিখতে শিখতে আগান। দশজনের নিকট থেকে যে ব্যবসা করতে চান সে সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। কাউকেই তুচ্ছজ্ঞান করবেন না। হেয় চোখে দেখবেন না। নিজেকে অন্য কেউ কেটা মনে করবেন না। নিজেকে খুব ছোট মনে করে ব্যবসার প্রতিটি ধাপ ঠান্ডা মাথায় অতিক্রম করেন, দেখবেন কীভাবে সফলতা আপনার পদচুম্বন করছে।

২। সবাইকে আপন ভাবতে শিখুন।
আমাদের একটা বড় দোষ হলো, শুধু আমরা আমরাই হক। বাকিরা সব বাতিল।এই রোগ থেকে বের হয়ে আসতে হবে।  ব্যবসায় সফল হতে হলে আপনি দেখবেন, অনেক সময় আপনার মহলের অনেক লোকের চেয়ে ভিন্ন মহলের লোককে খুব সৎ পাবেন, মহৎ পাবেন, বিশ্বস্ত পাবেন। সুতরাং আপনার কাজের স্বার্থে যাকে উত্তম বন্ধু রূপে পাবেন তাকেই কাছে টানুন। শুধু বেশভূষা দেখেই ধোকায় পড়ে যাবেন না। অনেক ধোকাবাজ সুন্নতি বেশ ধারণ করে আলেমদের কলঙ্কিত করে। আলেমদের ওপর জনসাধারণের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে প্রতারণা করে। এসব বিষয় খুব গুরুত্বের সাথে দেখবেন।

৩। নির্দিষ্ট পেশায় শীর্ষে পৌঁছার স্বপ্ন দেখুন
সব ধরণের ব্যবসা সবার পক্ষে করা সম্ভব নয়। যে যেই ব্যবসাটার প্রতি আগ্রহবোধ করেন, সেই লাইনেই আগান। হাটি হাটি পা-পা করে শুরু করুন। এক সময় দৌঁড়াতে পারবেন। হাঁটা শুরু করেই দৌঁড়াতে থাকবেন না। তাহলে সফল হতে পারবেন না। হোচট খেয়ে যাবেন। মনে রাখবেন, আমাদের সমাজের আইনী কাটামো আপনার অনুকূলে নয়। প্রতিটি ধাপেই আপনাকে নিরুৎসাহিত করবে। এসব দেওয়াল ভাঙ্গতে সময় লাগবে। সুতরাং তাড়াহুড়া করলেও হবে না। হাল ছেড়ে দিলেও হবে না। যে যেই কাজটা বুঝেন, সেই লাইনে শীর্ষে যাওয়ার স্বপ্ন দেখুন। সব জায়গায় সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন না।

৪। সততার নজির সৃষ্টি করতে চেষ্টা করুন।
খুব আফসোসের সাথে বলতে হয়, আমরা দুনিয়াবি লেন-দেনে খুবই দুর্বল। আপনি দশজনের অর্থ নিয়ে কোন যৌথ ব্যবসা শুরু করেছেন। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখবেন কোনভাবেই যেন কারো স্বার্থ আপনার দ্বারা অন্যায়ভাবে ক্ষুন্ন না হয়। মিথ্যা অহমিকায় পড়ে আমরা প্রায়শই নিজেদের অতীত ভুলে যাই। খুব তাড়াতাড়ি বড় লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করি। তখন বন্ধুদের দেওয়া আমানতের দায়িত্বের কথা ভুলে যাই। জনসাধারণের নিকট থেকে যে আশ্বাস দিয়ে অর্থ এনেছি তার দায়িত্বের কথা ভুলে যাই। এর খেসারত অতীতে আলেমদের দ্বারা পরিচালিত অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিয়েছে। এসব থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজেকে সৎ রাখতে চেষ্টা করুন। পকেটে পয়সা থাকলেই ভুলে যাবেন না আপনার দায়িত্বের কথা। মনে রাখবেন এই অর্থ আপনার না। এটা গ্রাহককে যথাসময়ে লাভসহ ফেরত দিতে হবে। যে দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে আপনি অর্থ সংগ্রহ করেছেন তা যথাযথ আদায়ের চেষ্টা করুন। সফলতা আসবেই ইনশাআল্লাহ।

৫। মিথ্যা আশ্বাস দিতে যাবেন না।
আমরা প্রায়শই নিজেদেরকে সফল করতে অন্যায় পথের আশ্রয় নিয়ে থাকি। ব্যবসায়িক পণ্য যেই মানের না, সেটা প্রচার করি। একজন আলেম থেকে কোন মানুষ ধোকা খেলে সে বড় আশাহত হবে। এসব বিষয়ে খুব খেয়াল করুন। অতি মুনাফাখোর চরিত্রে নিজেকে নিয়ে যাবেন না। কারণ আপনার এ চালাকি খুব তাড়াতাড়িই প্রকাশ হয়ে পড়বে। তখন খুব লজ্জিত হবেন। মনে রাখবেন, যে পথে যেই ব্যবসায় নামবেন সেটা দীর্ঘ মেয়াদী। দু’দিনেই শেষ হয়ে যাওয়ার নয়। আপনার প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসকে সম্মান করতে শিখুন। কোন অবস্থাতেই কাউকে মিথ্যা ব্যবসার আশ্বাস দিবেন না। সাময়িক লোভ সামলে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করুন। আল্লাহ তায়ালা ব্যবসায় বরকত দিবেন ইনশাআল্লাহ।

পরিশেষে বলতে চাই, ব্যবসার মধ্যে আল্লাহ তায়ালা যে বরকত রেখেছেন অন্য কোন পথে এমন সফল হওয়ার সুযোগ নেই। মনে রাখবেন  আপনি যদি সফল হন, এর মাধ্যমে  সফল হবে দেশের ইসলামী সমাজ, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী দাওয়াত। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। সকল প্রকার ধোকা, প্রতারণা, মিথ্যার আশ্রয় গ্রহন থেকে হেফাজত করুন।

লেখকঃ সৈয়দ সামসুল হুদা, রুফাকা টাওয়ার
টঙ্গী, গাজীপুর।



source https://deshdunianews.com/%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%ac%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%ae-%e0%a6%b8%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9c-%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%9b%e0%a7%81-%e0%a6%aa%e0%a6%b0/

0 Comments