ত্রাণচোর; একটি পর্যালোচনা

কে এম হুমায়ুন কবির:

বাংলাদেশের বর্তমানে আলোচিত সমালোচিত এক নাম; ত্রাণ চোর। চাল চোর,ডাল চোর,তেল চোর এ তালিকাভুক্ত। বর্তমানে স্বসম্মানে অনেকেই সামিল হচ্ছে ত্রাণচোরের মিছিলে। বর্তমানে সাধারণ জনগন মনে করেন জনপ্রতিনিধিই মানেই ত্রাণচোর। যার পাওয়ার যত বেশি তার চুরির ক্ষমতা তত বেশি। তবে সব জনপ্রতিনিধি ত্রাণ চোর বিষয়টা এরূপ নয়। সমস্ত ত্রাণচোর জনপ্রতিনিধি তবে সমস্ত জনপ্রতিনিধি ত্রাণচোর নয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চাল,ডাল আর তেল চুরির খবর পাওয়া যাচ্ছে। মাটি খুঁড়ে চালের খনি, খাটের নিচে তেলের খনি,শুধু খনি আর খনি। বর্তমান করোনা সংকট তৈরি না হলে বুঝাই যেত না বাংলাদেশে এত খনি আছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে গুগলে ‘চ’ লেখার সাথে সাথে চালচোর চলে আসে। গুগলেরও বুঝতে বাকি নেই যে আমরা চাল চোরই খুঁজছি।

করোনা সংকটের শুরুর দিকে করোনা রোগি থেকে চালচোরের সংখ্যা বেশি ছিল। কিন্তু বেচারা চোরেরা শেষ পর্যন্ত করোনার সাথে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেননি। এই ত্রাণচোরদের নিয়ে আমার দুটি প্রশ্ন।
১. করোনা সংকটেই ত্রাণচোরের উদ্ভব নাকি পূর্বেও ছিল?
২. ত্রাণচোরির জন্য কারা দায়ী?

এবার প্রশ্ন্ দুটি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

১. করোনা সংকটেই ত্রাণচোরের উদ্ভব? নাকি পূর্বেও ছিল?
মূলকথা হলো চোর যুগে যুগে ছিল,আছে এবং থাকবে। কেন থাকবে সেটা নিয়ে কথা বলবো। যদি বাংলাদেশের শুরুর দিকে তাকাই তাহলে সহজেই বুঝি বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘সবাই পেয়েছে স্বর্ণের খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি’। সুতরাং বিসমিল্লাতেই যদি গলদ থাকে তাহলে স্বাধিনতার অর্ধশত বছরে এসে আমরা ভালই চোরের রাজ্যে পরিণত হয়েছি। আর করোনা সে বিষয়টা আরো স্পষ্ট করে দিয়েছে যেটা এতদিন আমাদের অন্তরালে ছিল। সরকারি সহায়তা শুধু করোনাকালে নয় বরং সবসময় চলমান ছিল কিন্তু সেটা আমরা জানতাম না। এখন ত্রাণ দিচ্ছে সেটা আমরা সবাই জানি এজন্যই ত্রাণচোরেরা ধরা খাচ্ছে। এই চোরেরা খুব নিকৃষ্ট একটা প্রাণি। এদের লজ্জা,মানবিকতা এবং মনুষ্যত্ত্ব বলতে কিছুই নেই। নির্বোধ পশু প্রজাতির প্রাণি এরা। এদের সামান্য বিবেকবোধ থাকলে চলমান এ করোনা সংকটে অসহায় মানুষের ত্রাণ চুরি করে খেত না।

একবার ভাবুন: কাদের ত্রাণ চুরি করছি আমরা? যারা ক্ষুধার জ্বালায় ডাস্টবিন থেকে খাবার কুঁড়িয়ে খায়! যারা বাচ্চার দুধ কিনতে না পেরে বাবা দোকান থেকে দুধ চুরি করে! যারা সন্তানের দুধের জন্য মা তার মাথার চুল বিক্রি করে! যাদের ঘরে কয়েকদিন ধরে রান্না বন্ধ! যারা বলে পেটে অনেক খিদা এখন মানুষও খেয়ে ফেলতে পারবো! যারা একমুঠো খাবারের জন্য রাস্তায় রাস্তায় হাটে! যারা সারাদিন ভিক্ষা করে সে টাকা মেম্বারকে দিচ্ছে ত্রাণ পাওয়ার জন্য! আর সে ত্রাণ আমরা চুরি করে খাচ্ছি! তাহলে তোমার জন্য টয়লেটের ময়লা অনেক উত্তম খাবার। স্বাধীনতা থেকে শুরু করে চোরের বংশধরেরা যুগ যুগ ধরে আছে আমাদের মাঝে। তাদের প্রতিহত করার এখনই সময়। এখনই তাদেরকে রুখতে হবে।

ত্রাণচোরেরা যুগে যুগে থাকবে, কেন জানেন? আমাদের ভঙ্গুর বিচার ব্যবস্থার কারণে। আমরা গত কয়েক মাসে শত শত চারচোর দেখিছি কিন্তু কয়জনের বিচার হয়েছে? বরং সরকারের আমলাদের সাহায্য নিয়ে তারা আবার ঝাপিয়ে পড়ছে ত্রাণ চোরের মিছিলে। তাদের প্রতিহত করা সম্ভব নয় কারণ তাদের হাত অনেক বড়। এ চোরের ভাগ আমলা থেকে কামলা সবাই পাচ্ছে। প্রথম আলো রিপোর্টে দেখলাম করোনার দুর্যোগের সময় অভাবি মানুষের চাল আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অপরাধে ৫০ জন জনপ্রতিনিধিকে সামরিক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়। তাদের ৩৯ জনই সরকারি দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে পাঁচজন ছাড়া অন্যদের বিরুদ্ধে দলীয় কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

পরিস্থিতি যদি এরূপ থাকে তাহলে চালচোল প্রতিরোধ দূরের কথা বরং চোরের মহারাজ্যে পরিণত হবে আমার সোনার বাংলাদেশ। তবে ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলেছিলেন ‘আমার বাবা কম্বলচোরদের ছেড়ে দিলেও আমি ত্রাণচোরদের ছেড়ে দিব না।’ প্রধানমন্ত্রী একার পক্ষে চালচোর দমন হয়তবা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা সচেতন হলে দমন সম্ভব হবে। পারিবারিক,সামাজিক এবং রাষ্ট্রিয়ভাবে অনেক অনেক সচেতনতা প্রয়োজন এবং তাদের বয়কট করা দরকার।

এরা খুবই নির্লজ্জ এক প্রাণি। জনৈক ব্যক্তি বলেছেন-প্রধানমন্ত্রী এদেরকে কাপনের কাপড় দান করতে দিলে এরা তা দিয়ে পাঞ্জাবী বানিয়ে গায়ে দিবে। আরেকজন খুব মজা করে বলেছিলেন- বর্তমানে করোনা সংকটে সরকার প্রতিতাদের যদি ভাতা দেয় তাহলে কিছু কিছু নেতা তাতে তাদের মা-বোনদের নাম লেখিয়ে নিয়ে নিবে। সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারী ২৫০০ টাকা একই মেম্বারের মোবাইল নাম্বার পঞ্চাশ( ৫০), একশত (১০০) এমনকি দুইশত ( ২০০) বার পর্যন্ত। এরা মনুষ্যত্ত্ব বিকৃত এক প্রাণি। আল্লাহ এদেরকে হেদায়াত দান করুক।

২. ত্রাণ চুরির জন্য কারা দায়ী?
আমরা স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলে বুঝি ত্রাণচুরির জন্য ত্রাণচোরই দায়ী। কিন্তু এ ত্রাণচুরির জন্য শুধু ত্রাণচোরই দায়ী নয়। বরং আরো অনেকেই দায়ী। আমাদের শিক্ষা, সমাজ, পরিবার, জনগণ এমনকি আমাদের রাষ্ট্রও দায়ী।

(ক) জনগণ: আমরা জনগণ খুবই অদ্ভত এক প্রাণী। আমরা চোরের সঙ্গ দিতে জানি আর জনসম্মুখে সে চোরের বিচার দাবি করতে জানি। একজন ত্রাণচোরের ত্রাণ চুরি করার পিছনে আমরাও দায়ী। কারণ? আপনি একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কথা চিন্তা করুন। আমি আমার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কথা বলি। তিনি প্রথমে ৮০ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন নির্বাচনি খরচে কিন্তু সেবার নির্বাচিত হতে পারেননি। দ্বিতীয় বার পঞ্চাশ( ৫০) লক্ষ টাকা ব্যয় করে নির্বাচিত হয়েছেন। এবার চিন্তুা করুন ওনার মোট এক (১) কোটি ত্রিশ ( ৩০) লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হতে। এবার বলুন একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বেতন কত? বর্তমানে সম্ভবত তের হাজার পাঁচশত( ১৩৫০০) টাকা। মনে করুন পনের( ১৫০০০) টাকা। একজন চেয়ারম্যানের মেয়াদকাল পাঁচ (৫) বছর। পাঁচ (৫) বছরে বেতন বাবদ আসবে নয় (৯) লক্ষ টাকা। তাহলে বাকি এক ( ১) কোটি একুশ( ২১) লক্ষ টাকা কে দিবে???প্রথমবারের আশি (৮০) লক্ষ টাকা বাদ দিলেও আরো এক চল্লিশ (৪১) লক্ষ টাকা বাকি থাকে। তাহলে এবার আপনারাই বলুন ওনি ত্রাণ চুরি করবে না তো কি করবে? ভাগ্য ভালো ওনি ত্রাণ চুরি করেন কিন্তু ঘরে ঘরে ডাকাতি করেন না। নির্বাচনের সময় আমরা পাঁচশত/একহাজার (৫০০/১০০০) হাজার টাকা একটা নোট না ফেলে ভোট প্রদান করি না। এ সমস্ত টাকা নির্বাচনের সময় আমরাই খেয়েছি। তাহলে কিভাবে থেকে একজন চেয়ারম্যান থেকে ত্রাণ আশা করা যায়। বরং জনগণের উচিত ত্রাণ দিয়ে বেচারাকে সহযোগিতা করা।

(খ) নেতা: আমাদের নেতারাও কিন্তু এর জন্য দায়ী। কারণ একটা চেয়ারম্যান দলীয় নমিনেশন পেতে ভালো অংকের টাকা হাদিয়া দিতে হয়। বিভিন্নভাবে বিভিন্নখাতে দান-দক্ষিনা করতে হয়। তাতেই পেপার হাতে আসে।
রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থা: রাষ্ট্রে জবাবদিহিতামুলক বিচার ব্যবস্থা না থাকার কারণেই বার বার ত্রাণ চোরেরা পার পেয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র যদি এ বিষয়ে কার্যকরি ভূমিকা পালন করতো তাহলে এর সংখ্যা আরো সীমিত হয়ে আসতো।

(গ) পারিবারিক শিক্ষা: পারিবারিক দ্বীনি শিক্ষার অভাবেই পারিবারিবভাবে এ চোরের সৃষ্টি হচ্ছে। একটা ব্যক্তি পরিবারেই বেড়ে ওঠে এবং তা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেই বড় হয়। তাই ত্রাণচোর প্রতিরোধে পারিবারিক দ্বীনি শিক্ষা জোরদার করতে হবে। সাথে সাথে চোরের মানবিকতা ও মানসিকতা আরো উন্নত করতে হবে।

অবশেষে বলবো আমিই জনগণ, আমিই পরিবার, আমিই সমাজ, আমিই রাষ্ট্র। সুতরাং আমি পরিবর্তন হলেই সব পরিবর্তন সম্ভব। তাই আসুন আমি আমরা পরিবর্তন হয়ে যাই তাহলে গোটা রাষ্ট্র পরিবর্তন হয়ে যাবে। গড়ে উঠবে একটি মানবিক রাষ্ট্র।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়



source https://deshdunianews.com/%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a3%e0%a6%9a%e0%a7%8b%e0%a6%b0-%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a6%9f%e0%a6%bf-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%8b%e0%a6%9a%e0%a6%a8/

0 Comments