মুহাম্মাদ শাহীন বিন শফিক:
মুসলিম উম্মাহর কাছে অত্যন্ত মহিমান্বিত একটি রজনীর নাম লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। যে রাতে গভীর আবেগে আপ্লুত হয় প্রতিটি মুমিনের হৃদয়। ভারত উপমহাদেশীয় মুসলিম সমাজে শবে কদর নামটি অধিক প্রসিদ্ধ হলেও আসল ও কোরআন মাজীদের পরিভাষায় এর নাম হলো লাইলাতুল কদর। শবে কদর নামটি ফার্সি ভাষা থেকে আগত। আরবি লাইলাতুল আর ফার্সি শব দুটি শব্দের অর্থই রাত। আর কদর শব্দটিও উভয় ভাষাতে অভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর তা হলো মহান, মর্যাদা, নির্ধারণ করা ইত্যাদি। এ রাতটির ইবাদতের ফজিলত সীমাহীন এবং এ রাতে মহান আল্লাহ সৃষ্টিকূলের আগামী এক বছরের ভাগ্যলিপি ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করেন বলে রাতটির নাম শবে কদর বা লাইলাতুল ক্বদর করা হয়েছে।
শবে কদরের বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য
আল্লাহ ছুবহানাহু-ওয়া-তায়ালা শবে কদর রাতে সর্বপ্রথম পবিত্র কোরআন নাজিল করেন। এরশাদ হয়েছে,‘নিশ্চয়ই আমি ইহা (কোরআন) নাজিল করেছি কদরের রাতে, (সুরাতুল কদর : ১) এ রাতে হজরত জিবরাঈল (আ.) নবী ও রাসুলদের কাছে ঐশী বাণী নিয়ে পৃথিবীতে আসতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের মাধ্যমে নবুয়ত ও রেসালাতের ধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হজরত জিবরাঈলের পৃথিবীতে আগমনও বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বছরে একবার মাত্র কদরের রাতে আল্লাহর নির্দেশে রহমতের একদল ফেরেশতাকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন। এরশাদ হয়েছে,‘এ রাতে ফিরিশতারা এবং রূহ (জিবরাইল আ.) প্রত্যেক কাজের জন্য তাঁদের পালনকর্তার নির্দেশসহ অবতীর্ণ হন।’ (সুরাতুল কদর : ৪)
মহিমান্বিত শবে কদর রাতে আগামী এক বছরের জন্য সমগ্র সৃষ্টির ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা হয় । অর্থাৎ লওহে মাহফুজ থেকে তা নকল করে ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করা হয়। সুরাতুল কদরের ‘মিন কুল্লি আমরিন’ অংশের তাফসিরে কাতাদাহ প্রমুখ মুফাসসিরগণ বলেন, এ রাতে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং মানুষের হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়। (ইবনে কাসির)। হজরত ইমাম শা’বী (র.) লিখেছেন, লাইলাতুল কদরে ফেরেশতারা মসজিদবাসী মুমিনদের জন্য শান্তির দোয়া করতে থাকেন। এছাড়াও কদরের পূর্ণ রাতটি কল্যাণময়। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে, ‘রাতটি ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত কল্যাণময়।’ (সুরাতুল কদর : ৫)
শবে কদরের ফজিলত
লাইলাতুল কদরের ফজিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন,‘লাইলাতুল কদর সম্পর্কে তুমি কী জানো? কদরের রাত এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।’ (সুরাতুল কদর : ২,৩) লাইলাতুল কদরের ফজিলত সম্পর্কে এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : এ মাসে এমন একটা রাত আছে যা এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয় সে সত্যিকারের কপাল পোড়া। (ইবনে কাসির) অর্থাৎ একটি মাত্র রাত ‘লাইলাতুল কদরের’ ইবাদতের সওয়াব একাধারে তিরাশি বছর ইবাদত করার চেয়েও বেশি।
শবে কদর চেনার উপায়
শবে কদর কোন রাত? এ সম্পর্কে অনেক মতানৈক্য রয়েছে। অধিকাংশ ইসলামি স্কলারের মতে রমজানের শেষ দশকে শবে কদর লুকায়িত আছে। আর এ মতটাই দালিলিকভাবে বিশুদ্ধ বলে মনে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : তোমরা রমজান মাসের শেষ দশ দিনে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো (সসিহ আল-বোখারী : ২০১৭, সহিহ মুসলিম : ১১৬৭, ইবনে মাজা : ১৭৬৬, সুনানে আবু দাউদ : ১৩৮১, মুসনাদে আহমাদ : ২৫৬৯০
তবে কেউ কেউ রমজানের ২৭ তম রাতকে শবে কদর বলে থাকেন। এ ব্যাপারে হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি জোর দিয়ে বলতেন, রমজানের ২৭তম রাতই কদরের রাত।
যে রাতটি লাইলাতুল কদর হবে সেটি বুঝার কিছু আলামত হাদিস, আসার ও উলামায়ে কেরামের অভিজ্ঞতার আলোকে নিম্নে দেয়া হলো: রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না। রাতের যে কোন সময় হালকা বৃষ্টি হতে পারে। রাতটি নাতিশীতোষ্ণ হবে, অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না। মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে। সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে। সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে।
শবে কদরের আমল:
উম্মতে মুহাম্মদীকে শবে কদর দেয়া হয়েছে ইবাদতের জন্য। পূর্ববর্তী নবীগণের অনুসারীদের বয়সসীমা অধিক ছিল বিধায় তারা দীর্ঘকাল যাবত ইবাদতের সুযোগ পেত। উম্মতে মুহাম্মদীর যেহেতু আয়ু কম, তাই ইবাদতের বাহুল্যতা নিয়ে সাহাবায়ে কিরামের একধরণের অপ্রাপ্তির অনুশোচনাবোধ ছিল। আর তা পুষিয়ে দিতে আল্লাহ পাক এমন এক রাত উপহার দিলেন, যা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “লাইলাতুল কদরের বিশেষ আমল, সদক্বা, নামাজ, জাকাত- এগুলো এক হাজার মাসের আমল থেকেও উত্তম” (দুররে মনসুর)।
কদর রাতের অন্যতম আমল বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে কদরের রাতে নামাজে দাঁড়াবে, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে” (সহীহ বুখারী)।
এই রাতের সুন্নাতসিদ্ধ আরেকটি আমল দোয়া করা। হযরত মা আয়েশা সিদ্দিকা রা. রাসুলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে ঐ রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফউয়া, ফাফু আন্নি” অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন (সুনানে ইবনে মাজাহ)
এছাড়াও অধিক হারে ইস্তেগফার করা, কুরআন তেলাওয়াত করা, ধান সদকা করা, পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়ের কবর জিয়ারত, জিকির-আজকারে মশগুল থাকা ও দরুদ শরীফ পাঠ করা অত্যন্ত ফজিলতের কাজ।
শবে কদরের দোয়া
হজরত আয়েশা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! শবে কদর কোন রাত সেটা যদি আমি বুঝতে পারি তাহলে আমি তাতে কি দোয়া করব? তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, তুমি বলবে ,‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি’, অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালোবাসো অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। (জামে আত্-তিরমিজি : ৩৫১৩, সুনানে ইবনে মাজা : ৩৮৫০, আস্-সুনানুল কুবরা : ৭৬৬৫, মুসনাদে আহমাদ : ২৫৩৮৪)
লেখক: শিক্ষার্থী-কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ,
সাধারণ সম্পাদক ইশা ছাত্র আন্দোলন, ভিক্টোরিয়া কলেজ শাখা
source https://deshdunianews.com/%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%95%e0%a6%a6%e0%a6%b0-%e0%a6%8f%e0%a6%95-%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%ac/
0 Comments