মুফতি শামীম আল আরকামঃ অনেকেই ইফতার ও সাহরী বিষয়ক ক্যালেন্ডার সমূহে রামাদানকে রহমত,মাগফিরাত ও নাজাত বলে ৩ দশকে ভাগকরে উপস্থাপন করেন। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অনেক মসজিদের খতিব, মাহফিলের বক্তা ও সাধারণ আলেমগণের মুখেও বিষয়টির প্রচার-প্রসার ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়।
অথচ হাদিস বিশেষজ্ঞগণের মূল্যায়ণে ৩ দশকে বিভক্তিকৃত হাদিসটি-
‘মুনকার।’ (অগ্রহণযোগ্য, পরিত্যাজ্য)
♦ রহমত,মাগফিরাত ও নাজাতকে ৩ দশকে বিভক্তিকৃত হাদিস কোনটি?
হযরত সালমান আল- ফারসী রাদিয়াল্লাহু আনহুর নামে বর্ণনাকৃত রমজানের ৩ দশককে বিভক্তিকৃত হাদিসটি – হাদিসগ্রন্থ শুয়াবুল ঈমানের ৩৩৩৬ ও ইবনু খুজায়মার ১৮৮৭ নং হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। দীর্ঘ হাদিসটির শেষাংশে উল্লেখকরা হয়েছে;
وَهُوَ شَهْرٌ أَوَّلُهُ رَحْمَةٌ، وَأَوْسَطُهُ مَغْفِرَةٌ، وَآخِرُهُ عِتْقٌ مِنَ النَّارِ-
অর্থাৎ; এ মাসের প্রথমদশক রহমত বা দয়ার, দ্বিতীয়দশক মাগফিরাত বা ক্ষমার এবং তৃতীয়দশক জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি বা নাজাতের।
♦ ‘মুনকার’ হাদিস কাকে বলে?
১) যে হাদিসের বর্ণনাকারী শরয়ী দৃষ্টিকোন থেকে দুর্বল, বা হাদিস বর্ণনার যাবতীয় গুণাবলী যারমধ্যে পাওয়া যায়না তার বর্ণনাকৃত হাদিসকে ‘মুনকার’ হাদিস বলে।
২) কোন দুর্বল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদিস অপরকোন বিশ্বস্ত বা নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর হাদিসের সাথে অর্থ ও ভাবগত দিকথেকে সাংঘর্ষিক হলে তখন উক্ত হাদিসকে ‘মুনকার’ হাদিস বলা হয়।
♦ সালমান ফারসী রাদিআল্লাহু আনহুর নামে বর্ণিত ৩ দশকে বিভক্তিকৃত হাদিসটি কেন ‘মুনকার’ হল?
অনেকেরমতো বিখ্যাত হাদিস বিশেষজ্ঞ ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল কাত্তান রাহিমাহুল্লাহ বলেন- উক্ত হাদিসটির বর্ণনাকারীদের একজন আলী ইবনু যায়িদ ইবনু জুদ’আন। তিনি আকিদাগতভাবে একজন শিয়া সম্প্রদায়ের লোক। সুতরাং তাঁর হাদিস প্রত্যাখানযোগ্য। এছাড়াও ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল ও ইহাহইয়া বিন মুঈন রাহিমাহুল্লাহুমা উভয়ের মত হল; আলী ইবনু জায়িদ ইবনু জুদ’আনের বর্ণনাকৃত হাদিস নির্ভরযোগ্য নয় বরং তা ‘মুনকার।’
[ তথ্য: কিতাবুদ দু’আফা লিল উকাইলী; খন্ডনং- ২, পৃষ্ঠানং- ১৬২। সিলসিলাতিল আহাদিসুয যায়ীফা- খন্ডনং- ৪, পৃষ্ঠানং- ৭০। ]
এ ছাড়াও রাহমাত,মাগফিরাত ও নাজাতকে ৩ দশকে বিভক্তিকৃত উপরোক্ত হাদিসটি বিশ্বস্তসূত্রে বর্ণনাকৃত একাধিক সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক। তাই উপরোক্ত হাদিসটির ভিত্তিতে রামাদানকে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের ৩ দশকে ভাগকরা কোনভাবেই সঠিক হবে না।
♦ ৩ দশকে বিভক্তিকৃত হাদিসটি সহীহ সনদে বর্ণিত কোন কোন হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক?
১) আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসটি হল-
إِذَا دَخَلَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ وَسُلْسِلَتْ الشَّيَاطِينُ-
‘যখন রামাদান আসে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শিকলবদ্ধ করে ফেলা হয়।’
হাদীসটির সনদের মান সহীহ। এটি সহীহ বুখারীর হাদীসনং- ৩২৭৭, সহীহ মুসলিমের হাদীসনং- ১০৭৯, তিরমিযীর হাদীসনং- ৬১৮, নাসাঈর হাদীসনং- ২০৭০, ইবনু মাযাহর হাদীসনং- ১৬৩২, মুসনাদে আহমাদের হাদীসনং- ৭১০৮, মুয়াত্তা ইমাম মালিকের হাদীসনং- ৬৯১, দারেমীর হাদীসনং- ১৭১০- এ বর্ণিত হয়েছে।
২) আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত
إِذَا دَخَلَ شَهْرُ رَمَضَانَ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ ، وَسُلْسِلَتْ الشَّيَاطِينُ-
‘যখন রামাদান আসে তখন আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শিকলবদ্ধ করে ফেলা হয়।’
সহীহ বুখারী হাদীসনং- ১৮৯৯, নাসাঈ হাদীসনং- ২০৭৯, দারেমী হাদীসনং- ১৭১০।
৩) আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত
إِذَا كَانَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ وَسُلْسِلَت الشَّيَاطِينُ –
‘যখন রামাদান আসে তখন রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শিকলবদ্ধ করে ফেলা হয়।’
সহীহ মুসলিম হাদীসনং- ১০৭৯, নাসাঈ হাদীসনং- ২০৭৩/ ২০৭৮, মুসনাদে আহমাদ হাদীসনং- ৭৭২৩/ ৮৯৫১।
উপরোল্লিখিত এ হাদিস সমূহের ইবারত একেক কিতাবে একেকশব্দে বর্ণিত হয়েছে , যেমন প্রথম উল্লিখিত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ
খুলে দেয়া হয় জান্নাতের দরজাসমূহ।
দ্বিতীয় হাদীসে –
فُتِّحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ
খুলে দেয়া হয় আসমানের দরজাসমূহ।
এখানে জান্নাতের পরিবর্তে আসমান শব্দটি ব্যবহার হয়েছে।
তেমনিভাবে আর কোন কোন কিতাবে অন্যভাবে এসেছে। যেমন-
فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ
খুলে দেয়া হয় রহমতের দরজাসমূহ।
এখানে জান্নাত ও আসমানের পরিবর্তে রহমতের দরজা সমূহ খুলে দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
আসল কথা হল; ঠিক কতদিনের জন্য রাহমাতের দরজা খুলে দেয়া হয়েছে তা যেহেতু উল্লেখকরা হয়নি সুতরাং এখানে পুরো রামাদানকেই রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস হিসেবে মনে করতে হবে।
এবিষয়ে আরেকটি নির্ভরযোগ্য দলীল হল ;
সাহাবী আবু হোরায়রা রাদিঅাল্লাহু আনহু বর্ণিত নিন্মোল্লিখিত হাদীসটি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِذَا كَانَ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ
যখন রামাদান মাসের প্রথমরাত আসে।
صُفِّدَتْ الشَّيَاطِينُ وَمَرَدَةُ الْجِنِّ
শৃঙ্খলবদ্ধকরে ফেলা হয় শয়তান এবং দুষ্ট জীনকে।
وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ
আর বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজা সমূহ।
فَلَمْ يُفْتَحْ مِنْهَا بَابٌ
অতপর সে দরজাসমূহ আর খোলা হয়না।
وَفُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ
এবং খুলে দেয়া হয় জান্নাতের দরজা সমূহ
فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ
অতপর সে দরজা সমুহ আর বন্ধ করা হয়না।
وَيُنَادِي مُنَادٍ
আর একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে
يَا بَاغِيَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ
হে কল্যাণ অন্বেষণকারী সামনে আগাও
وَيَا بَاغِيَ الشَّرِّ أَقْصِرْ
হে মন্দ অন্বেষণকারী থেমে যাও
، وَلِلَّهِ عُتَقَاءُ مِنْ النَّارِ وَذَلكَ كُلُّ لَيْلَةٍ
এ মাসের প্রতিরাতেই আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন।
[ তিরমিযী হাদীসনং- ৬১৮, ইবনু মাযাহ হাদীসনং- ১৬৩২ ]
উপরোক্ত হাদীসের প্রথমাংশ প্রমাণ করে যে;
রহমত, জান্নাত বা আসমানের দরজা কেবল প্রথম দশকে নয়, বরং তা পুরো রামাদানের তিন দশকেই খোলা থাকে।
অতপর হাদীসটির শেষলাইন প্রমাণকরে; শুধু শেষ দশক নয় বরং প্রতিরাতেই আল্লাহ জাহান্নাম থেকে বান্দাকে নাজাত বা মুক্তি দিয়ে থাকেন।
♦ ‘মাগফিরাত’ বা ক্ষমা :
মাগফিরাত বা ক্ষমাকে যদি দ্বিতীয় দশকের জন্য নির্দিষ্ট করা হয় তাহলেও এ হাদিসটি নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত ৩ টি প্রশিদ্ধ হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়।
যেমন;
হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনাকৃত সহীহ বুখারীর ১৯০১, সহীহ মুসলিমের ৭৬৯ এবং ইবনু মাযাহ’র ১৩২৬ নং হাদিসে সহীহসূত্রে এসেছে-
‘যে ব্যক্তি ঈমান অবস্থায় এবং সাওয়াবের আশায় রমজানের সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর পূর্বের সকল গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন।’ একই হাদিসের শেষভাগে এসেছে-
مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه –
‘যে ব্যক্তি ঈমান অবস্থায় এবং সাওয়াবের আশায় লাইলাতুল কাদরে রাতজেগে ইবাদাত করবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর পুর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। ‘
একথা সুস্পষ্ট যে, লাইলাতুল কদর দ্বিতীয় দশকে নয় বরং তা শেষ দশকে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সুতরাং দ্বিতীয় দশককে মাগফিরাত বা ক্ষমার দশক বলা সঠিক নয়।
এছাড়াও আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত সাহীহ বুখারীর ১৯০১ নং হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমান অবস্থায় এবং সাওয়াবের আশায় রমজানে রাতজেগে ইবাদাত করবে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর পুর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’
সুতরাং এখানেও বুঝা গেলো ‘মাগফিরাত’ বা ক্ষমা শুধু দ্বিতীয় দশকে নয়, বরং তা গোটা রমজানের জন্যই প্রযোজ্য হবে।
♦ ‘নাজাত’ বা মুক্তি :
৩ দশকে বিভক্তিকৃত হাদিসে কেবল তৃতীয় দশককে নাজাতের দশক বলা হয়েছে। অথচ ইবনু মাযাহ’র ১৬৪২ নং হাদিসে হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক সাহীহসূত্রে বর্ণিত হয়েছে; আল্লাহ তায়ালা রমজানের প্রতিরাতেই তার পছন্দের বান্দাকে জাহান্নাম থেকে ‘নাজাত’ বা মুক্তি দিয়ে থাকেন।
এ ছাড়াও সহীহ মুসলিমের ২৫৫১ ও তিরমিযির ৩৫৪৫ নং হাদিসে হযরত কা’ব বিন উজারা রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে; তিনি বলেন, ‘নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা মিম্বরে আরোহণ করছিলেন। প্রথম সিঁড়িতে পা রাখার সময় তিনি ‘আমীন’ বললেন। এভাবে তিনটি সিঁড়িতে পা রাখতে গিয়ে তিনি আমীন বললেন। নবীজীর কাছে আমরা জানতে চাইলাম এটার কারণ সম্পর্কে?
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘আমি প্রথম সিঁড়িতে পা রাখার সময় জিবরাঈল আমাকে বললেন, যে ব্যক্তি রমজান পেলো অথচ গুনাহ ক্ষমা করাতে পারলোনা সে ধ্বংস হোক।
আমি কথাটি সমর্থন করে বললাম ‘আমীন।’
এখানেও বুঝা গেলো ‘নাজাত’ বা মুক্তি কেবল তৃতীয় দশকে সীমাবদ্ধ নয়। বরং পুরো রমজান মাস জুড়েই নাজাত বা মুক্তি মিলবে।
ইনশা আল্লাহ।
সুতরাং রমজানকে ৩ দশকে ভাগ করা হতে বিরত থাকুন। মহিমান্বিত মাসটির প্রতিটি দিনে/ রাতেই রাহমাত, বারাকাত, মাগফিরাত ও নাজাত তালাশ করুন।
লেখকঃ
সভাপতি, মারকাযুস সাহাবা বাংলাদেশ।
source https://deshdunianews.com/%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%b8-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%8b%e0%a6%9a%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%be/
0 Comments