ইঞ্জিনিয়ার কামরুল হাছান::
স্থান-নাম (Toponym) বলতে কোন লোকালয়, অঞ্চল বা ভূ-পৃষ্ঠের অন্য কোন অংশের (প্রাকৃতিক অংশ, যেমন- নদীর নাম, কিংবা মনুষ্যনির্মিত অংশ, যেমন- শহরের নাম) নামকে বোঝায়।
অনেকে বলেন,নামে কি আসে যায়? কর্মইতো আসল ।আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি , নামেও অনেক কিছু আসে যায়। কারণ, প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী স্থান-নামগুলি কোন অঞ্চলের পেছনের মনুষ্য ইতিহাসের স্বাক্ষর বহন করে। নাম হচ্ছে, চিহ্ন। নামের মধ্যে থাকে তার আত্মপরিচয় অর্থাৎ শিকড়ের সন্ধান। কোন স্থানের নাম যখন বিকৃত হয়ে যায়, তখন, ঐ জনপদের মানুষ তার শিকড় থেকে দূরে সরে যায় ও আত্নপরিচয়ের সংকটে ভূগে।
মহাগ্রন্থ আল কুরআন আমাদেরকে নামকে বিকৃত, উপহাস করতে, অথবা মন্দ নামে ডাকতে নিষেধ করে। যেমন কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। (সূরা হুজরাত, আয়াত: ১১)
আমাদের উপজেলার শিকড়ের সন্ধান করতে গেলে এর নামটি আমাদেরকে অনেক ভাবায়। নামটির যদি সন্ধি বিচ্ছেদ করি তাহলে হয়, ছাগল +নাইয়া হয়। ছাগল একটা প্রাণী, আর নাইয়া অর্থ মাঝি বা নাবিক। মাঝি বা নাবিকের সাথে ছাগলের সম্পর্ক নেই, আছে সাগর, অথবা নদীর সাথে ।
তাই আমাদের সন্দেহ হয়, অফিসিয়াল কোন ভূলে, অথবা আঞ্চলিক উচ্চারণগত সমস্যার কারণে কালের পরিক্রমায় বিকৃত হয়েছে, অথবা কেউ আমাদেরকে হেয় বা উপহাস করার জন্য, কিংবা শিকড় ভূলিয়ে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করে বিকৃত করে ফেলেছে। এই সম্পর্কে আরো তথ্য অনুসন্ধানে ৩ টি উপাখ্যানের সাথে পরিচিত হই।
ছাগলনাইয়া নামটি সম্পর্কে তিনটি মতামত পাওয়া যায়। (১) রাখাল বালকের গল্প (২)মাহাত্মা গান্ধি (৩) সাগরনাইয়া লেখায় ভুল
[১] রাখাল বালকের গল্পটি হলো,
প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে এখানে একটি সাগরের পাড় ছিল। সাগর পাড়ে এক রাখাল ছিল। রাখালের অনেকগুলো ছাগল ছিল। একদিন ছাগলগুলো সাগরের কিনারায় পানি খেতে গেলো। এই দেখে রাখালও পানি খেতে বাড়িতে গেলো। রাখাল সাগর পাড়ে এসে দেখে একটা ছাগলও নেই । রাখাল মানসিক ভারসাম্য হারান। সাগরে ডিল মারতে থাকেন। বলতে থাকেন ” ছাগল খাইয়া “। যে কেউ এখান দিয়ে যেতেন মানসিক ভারসাম্যহীন সেই রাখালের মুখে ছাগল খাইয়া শব্দটি শুনতে পেতো। সেই কারনে ৪০০ বছর পূর্বে এই জাগটিকে মানুষ ছাগল খাইয়া হিসেবে চিনতো। ২০০ বছর পরে ঐতিহাসিকরা গবেষণা করে দেখলো, রাখাল সাগর পাড়ে তার ছাগল নাই দেখেছে। খেতে দেখে নাই। তাই তারা ভাবলো এই জায়গাটির নাম ছাগল নাইয়া হওয়া উচিত। পরবর্তীতে এই জায়গাটি ছাগলনাইয়া হয়।
প্রশ্ন,
ক)ছাগল যেহেতু ঐতিহাসিক ফিগার সেহেতু তার নাম কি এবং সে কোথায় থাকতো?
খ) ছাগলের পাল কি লোনা জল খায়?
গ) কোন রাখাল কি তার পালকে রেখে শুধুমাত্র পানি খাওয়ার জন্য বাড়ি আসে?
ঘ) খাইয়া দিয়ে কি এই অঞ্চলে নাই বুজাতো?
[২] গান্ধীর ছাগল চুরির ঘটনা।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ। অবিভক্ত ভারতের নোয়াখালী জুড়ে শুরু হয় ভয়ঙ্কর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। এই খবর মহাত্মা গান্ধীর কাছে পৌঁছালে দাঙ্গা নিরসনে তিনি তত্ক্ষণাত্ নোয়াখালী আসার সিদ্ধান্ত নেন। ৭ নভেম্বর ১৯৪৬-এ তিনি নোয়াখালীর চৌমুহনী রেলস্টেশনে এসে পৌঁছেন। তিনি ছাগলের দুধ পান করতেন বলে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন নিজের ছাগলটিও। কিন্তু নোয়াখালীতে আসার পর আকস্মিকভাবে তাঁর ছাগল চুরি হয়ে যায়। কেউ কেউ মহাত্মা গান্ধীর এই ছাগল চুরির ঘটনা থেকেই ছাগলনাইয়া নামের উত্পত্তি বলে মনে করে থাকেন।
প্রশ্ন, মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী এসেছিলেন ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে, আর ছাগলনাইয়া নামকরণ হয়েছে ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। যেহেতু মাহাত্মা গান্ধি কখনো এই জায়গায় আসেনইনাই সেহেতু কিভাবে এই স্থানের নাম ছাগলনাইয়া হল?
[৩] সাগরনাইয়া লেখায় বানান ভুল
ফেনী ও মহুরী নদী বিধৌত ছাগলনাইয়া উপজেলার আয়তন ১৩৩.৪৯ কলােমিটার এবং লােকসংখ্যা ১৬৪৯২০। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর এর প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাগলনাইয়া তা এখানকার লােকজন নদীকে সাগর বলত। গ্রামাঞ্চলের লােকজন এখনাে নদীকে সাগর বলে থাকেন। আলােচ্য এলাকার একটি মহল্লায় সাগর নাইয়া তথা নদীর মাঝিদের নিবাস ছিল। সর্বসাধারণের কাছে মহল্লা বা পাড়াটি সাগরনাইয়া নামে পরিচিত ছিল। ইংরেজ আমলে ভূমি জরিপকালে কর্মচারীগণ ভুল কিংবা অসাবধানতাবশত Sagor’ শব্দটি Sagol লিখে নেন। ফলে এলাকাটির নাম হয়ে যায় Sagolnaia। ফলে এলাকাটি ছাগলনাইয়া নামে পরিচিতি পেয়ে যায়। শিলুয়ার শিল, শুভপুর ব্রিজ, বাঁশপাড়া জমিদার বাড়ি ও সাত মন্দির, কৈয়ারা দীঘি ও শমসের গাজীর রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ এ উপজেলার প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ। এ উপজেলা সদর থেকে সাত কিলােমিটার উত্তরে আমজাদহাট গ্রামের। একজন কৃষক ফসিল-কাঠে তৈরি প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটি কুঠার পান। এটি ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে সংরক্ষণের জন্য জাতীয় যাদুঘরে প্রদান করা হয়।
সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান এবং সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় ঐতিহাসিকভাবে – বিশেষত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই অঞ্চলের সাথে ছাগলের কোন সম্পর্ক নেই। অপর দিকে এটি সাগরের চর জমে জমে সৃষ্ট অঞ্চল আর ‘নাইয়া’ মানে মাঝি অথবা নাবিক। তার মানে, সাগরনাইয়া নামের অর্থ দাড়ায় “সাগরের মাঝি, বা সাগরের নাবিক”। এটাই অধিক যুক্তিযুক্ত।
‘সাগরনাইয়া’ নামটি অর্থপূর্ণ, শুনতে সাহিত্যিক ও মার্জিত শুনায়। এই নামের স্বপক্ষে অনেক ঐতিহাসিক প্রবন্ধ, বই পাওয়া যায়।
এই জন্য এই উপজেলার নাম পরিবর্তন করা আমাদের সকলের একান্ত দাবী। আমরা মনেকরি, একটি সভ্য জনগোষ্ঠির বৈশিষ্ট্য হল, প্রগতিশীল কর্মের সাথে সাথে অবিকৃত ও সুন্দর অর্থপূর্ণ নাম। ছাগলনাইয়া নামটি একাধারে অর্থহীন, গাঠনিক দিক দিয়েও অশুদ্ধ এবং ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি নেই। ছাগলনাইয়া থেকে অধিক মার্জিত ও যুক্তিযুক্ত নাম, ‘সাগরনাইয়া’। আমরা পুরো নামের পরিবর্তন চাচ্ছিনা বরং ‘ছাগল’ এর স্থলে ‘সাগর’ হওয়ার কথা বলছি। ‘নাইয়া’ আগের মতই থাকবে। ছাগলনাইয়া হল সাগরনাইয়া এর বিকৃতরুপ।
এটি এই অঞ্চলের অনেকের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয় কর্মক্ষেত্রে ও পড়াশুনার ক্ষেত্রে। যেইভাবে ইতিপূর্বে অনেক জেলার নামের পরিবর্তন হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে সংশ্লিষ্ট মহলের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করব, আমাদের থানার নাম ছাগলনাইয়া থেকে সাগরনাইয়া রুপান্তরের জন্য।
নামের বানান শুদ্ধ করে আদিরুপ ফিরিয়ে আনতে গেলে অনেকে কাগজপত্রের জটিলতার ইস্যু সামনে নিয়ে আসছেন। তাদের প্রতিও বিনয়ীভাবে বলছি, বাংলাদেশের ইতিহাসে বিভাগ সমুহের নাম পরিবর্তন হয়েছে যেমন শ্রী হট্ট থেকে সিলেট, চাটিগাঁও থেকে চট্টগ্রাম।
সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তন হয়েছে। পুরাতন কাগজপত্র আগের নিয়মেই থাকবে, নতুনগুলো নতুন নামে ইস্যু হবে। এই নাম পরিবর্তন হয় প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার) মাধ্যমে যার আহবায়ক হলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ।
যেহেতু সরকার নাম পরিবর্তন করবে সেহেতু পুরাতন কাগজপত্র সংশোধনের প্রয়োজন হলে, সেগুলো কোন ভোগান্তি ছাড়া দ্রুততম সময়ে হয়ে যাবে।
এই প্রসঙ্গ অনলাইন সাগরনাইয়া আন্দোলনের আহবায়ক শরীফুল ইসলাম লিংকন বলেন,
ছাগলনাইয়া অঞ্চলটি মূলত ত্রিপুরা রাজ্যের জমিদার মহারাজা বীর বিক্রম রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুরের জমিদারের অংশে ছিল। এই জমিদারের চাকলা রৌশনাবাদ এষ্টেটের আওতায় বর্তমান পূর্ব- ছাগলনাইয়া গ্রামের রাধানগর বাজারে চাকলা রৌশনাবাদ সদর কাচারী স্থাপন করেন যা বর্তমানে রাধানগর ভূমি অফিস নামে পরিচিত।
এই কাচারীর মাধ্যমে এই অঞ্চলের জমিদারীর যাবতীয় খাজনাদি আদায়সহ জমিদারী ব্যবস্থা কার্যাদি পরিচালিত হত। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে এই সমগ্র উপজেলার পূর্ব নাম ছিল ”চাকলা রৌশনাবাদ”। অপর দিকে বৃটিশ আমলে ফেনী মহকুমা র আওতায় এই এলাকার জন্য থানা স্থাপন করা হয় পূর্ব ও পশ্চিম ছাগলনাইয়া গ্রামের মাঝে। (যদিও সাগরনাইয়া থেকে বানান ভূলে ছাগলনাইয়া হয়েছে)। যেহেতু থানা তথাকথিত ছাগলনাইয়া এলাকায় স্থাপন করা হয়, তাই সমগ্র উপজেলার নাম হয়ে যায় ছাগলনাইয়া।
তাছাড়া আমার কাছে এই এলাকার বৃটিশ আমলে ম্যাপ সংরক্ষিত আছে … যেখানে এর নাম চাকলা রৌশনাবাদ লিখা আছে।
মৌঘল আমলের আগে এই অঞ্চলে কোন জনবসতি ছিল না। রানীর হাট (মূলত রাণীর ঘাট) থেকে বাশঁপাড়া গ্রাম পর্যন্ত পানি দ্বারা প্লাবন ভূমি ছিল। ফলে বর্তমান ছাগলনাইয়ার মধ্যভাবে কোন পূরাকৃর্তী নেই বলেই চলে। যদিও শিলুয়ার শিলটি হচ্ছে সবচেয়ে পুরাতন স্থাপনা, বিজ্ঞানিরা ধারণা করছেন এটি পূর্ব-উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে পানির স্রতে বেসে এসেছে।
সুতরাং পূর্বে জলমগ্ন এই অঞ্চল দেখতে সাগরের মত ছিল তাই এই এলাকার নাম সাগরনাইয়া হওয়ার পক্ষে অধিক যৌক্তিক মনে করছি।
“আমরা সাগরনাইয়ার সন্তান ”
ইঞ্জিনিয়ার কামরুল হাছান
কলম সৈনিক সাগরনাইয়া আন্দোলন
source https://deshdunianews.com/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%ae-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%95-%e0%a6%9b%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%b8/
0 Comments