শাইখ আল্লামা শাহ তৈয়ব (রহ.): ব্যক্তিত্ব ও বিশেষত্ব

দেশ দুনিয়া নিউজঃ (চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জিরি মাদ্রাসার দীর্ঘ দিনের মুহতামিম সদ্য প্রয়াত আল্লামা তৈয়ব (রহ) ছিলেন বহু গুণাবলীর অধিকারী একজন অনুসরণীয় ব্যক্তি ৷ তাঁর ব্যক্তিত্ব ও বিশেষত্বগুলো পাঠকের সমীপে তুলে ধরছেন বিশিষ্ট লেখক মু সগির চৌধুরী)

এক. তিনি ছিলেন বুলবুলে চাটগাম
পারস্পরিক কথোপকথন, পারিবারিক আলাপ ও সামাজিক আলাপ-আলোচনায় চাঁটগায়া ভাষায় আমরা বেশ ভালো করেই কথা বলি। মনে ভাব ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করি, কিন্তু যখনই কোথাও দাঁড়াই মনের অজান্তেই বাংলার লিখিত ভাষায় বলতে শুরু করা হয়। শহর-উপশহর তো বটেই, এ প্রবণতা এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে, স্মার্ট ইমাম-খতীবগণ বাংলার লিখিত ভাষাতেই কথা বলেন।
কিন্তু আমার শায়খ শাহ মুহাম্মদ তৈয়ব (রহ.) ছিলেন চট্টগ্রামের বুলবুল। তিনি জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতেন, শাস্ত্রীয় কথা বলতেন, নসীহত করতেন, মাসআলা বর্ণনা করতেন, ওয়াযে মানুষকে হাসাতেন-কাঁদাতেন, এর সবই ছিল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়, চট্টগ্রামী মানুষের মুখের ভাষায় এবং তাদের হৃদয়ের অভিব্যক্তিতে। তাঁর বয়ানে দরদ, আবেগ, ভালবাসা, আবেদন, বিনয়, উৎসাহ, ভীতি ও সতর্কতা ইত্যাদি ছিল, এক অসাধারণ ভঙ্গিমায় তিনি তা প্রকাশ ঘটাতেন চট্টগ্রামের ভাষায়। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা যে এতো ফসীহ-বলীগ, বলিষ্ট, সুমধুর, হৃদয়গ্রাহী ও শ্রুতিসুন্দরও হতে পারে তা আমার শায়খের বয়ান শুনলেই বোঝা যায়।

দুই. তাঁর সম্বোধন: অ মিয়া!, অ মুসলমান! অ মৌলঅই সাব!
শায়খ তাঁর ছাত্রদেরকে ‘অ মৌলঅই সাব!’ ডাকতেন, তাঁর এই ডাকটি শুনতে বেশ ভালো লাগতো। একটি মায়াময় ডাক, স্নেহপূর্ণ; তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের ছোট-বড় সকলকে এই আহ্বানে সম্বোধন করতেন, খুব দুঃখ হবে তাঁর প্রিয় ছাত্রদের জন্য এই ডাক না শুনতে পাবে সেজন্য।
তিনি বয়ান ও ওয়াযে শ্রোতাদের ‘অ মুসলমান!’ এবং বেশির ভাগ সময় ‘অ মিয়া’ বলে সম্বোধন করতেন। তাঁর এই আহ্বানে একজন অভিভাবকসুলভ অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে, একই সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রতিকৃতিও প্রকাশিত হতো। তিনি কথা বলতেন যে, সমব্যথী হিসেবে, বিনয়ের সাথে, আবেদনমূলক। তিনি কথার মাঝে মাঝে ‘অহ্’ বলে একটি ধাক্কা দিয়ে আওয়াজ দিতেন, এটি মানুষের হৃদয়ে কম্পনের সৃষ্টি করতো। কথার মাঝে মাঝে ‘আল্লা-হ আল্লা-হ’ বলে তাকবীর দিতেন, এটিও শ্রোতাদের মাঝে প্রভাব সৃষ্টি করতো।

তিন. কাজের মানুষকে উদারচিত্তে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন
তিনি একজন বড় আলেম ছিলেন, সম্মানিত পীর ছিলেন, দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তর মাদরাসার দীর্ঘদিনের মহাপরিচালক ছিলেন, পারিবারিকভাবে ছিলেন খান্দানি। এসব সত্ত্বেও তিনি অন্যান্যদেরকে উপেক্ষা করতেন না, এসবের ভাব প্রকাশ করতেন না। যারা মাঠে-ময়দানে দাওয়াতী কাজ করেন বা যাদের দ্বারা সাধারণ মুসলমানদের মাঝে দাওয়াতী খেদমত হচ্ছে বলে মনে করতেন তিনি তাঁদেরকে জোরালোভাবে সমর্থন করতেন, পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন এবং সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে তাদের সহযোগী হতেন। এসব ক্ষেত্রে তারা ইলমে-জ্ঞানে ছোট কি বড় এসবের মোটেও পরওয়া করতেন না।
এই কারণেই তিনি আজীবন চরমোনাইয়ের পীর সাহেব সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম (রহ.)-কে তাঁর কাজে সার্বিক সহযোগিতা করতেন, তিনিই অন্যতম প্রধান যিনি হযরত পীর সাহেব চরমোনাইয়ের প্রতিকূল রাজনীতিক সময়েও তাঁকে জোরালোভাবে সমর্থন যুগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জামিয়া জিরির মাহফিলে চরমোনাইযের বর্তমান শায়খদেরকেও অত্যন্ত সস্নেহে দাওয়াত দিতেন এবং মাহফিলের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বয়ানের সুযোগ দিতেন। এতে চরমোনাইয়ের ভক্ত বেড়ে যাবে এমন হীনস্মন্যতায় তিনি মোটেও ভুগতেন না। একইভাবে নন্দিত বক্তা মাওলানা হাফিযুর রহমান ও হাবিুর রহমান কুয়াকাটা ভাতৃদ্বয়কেও অভিভাবকত্ব দিয়েছেন তিনি।

চার. তিনি সরল ছিলেন
আমার খুব মনে আছে, ২০০০ সাল বা তারপরেও আমার শায়খ ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। এ নিয়ে শায়খের আত্মতৃপ্তির শেষ ছিল না, সরলভাবে প্রসঙ্গক্রমে বলতেন, আমি আন্দোলনের স্টেডিয়াম সদস্য। কথাটা বললে আমরা যে কিভাবে হাসি চাপিয়ে রাখতাম বলে বোঝাতে পারবো না, এমনকি শায়খ নিজেও কথাটা বলে হেসে দিতেন। অর্থাৎ কথাটি যে শায়খ মজাক করে বলছেন তা তিনি নিজেও হয়তো জানেন।

পাঁচ. তিনি গুরুত্ব দিতেন আখলাকি উন্নতি ও আমলি তরক্কিতে
শায়খ লন্ডন যেতেন প্রায়, সেখান অমুসলিমদের আখলাকের কথা ওয়াযে এসে ব্যক্ত করতেন। খুব আফসোস করে বলতেন, ‘অ মিয়া! কিচ্ছু নাই তারার, শুধু আখলাক ছাড়া।’ তিনি আকাবেরে দীনের সুহবত গ্রহণে উদ্ধুব্ধ করতেন এবং তাঁদের কারো অধীনে মানুষের আমলের তরক্কিতে গুরুত্ব দিতেন। তিনি ওয়াযে যিকিরের তালকীন করাতেন, এসময় তিনি উজানীর কারী মুহাম্মদ ইবরাহীম (রহ.)-এর ঘটনা বর্ণনা করতেন, বলতেন, ‘অ মিয়া! উজানির কারী সাব যখন লা-ইলাহ বলে ডানে মুখ ফেরাতেন পুরা মসজিদ ডান দিকে কাত হয়ে যেতো, যখন ইল্লাল্লাহ বলে বাম দিকে ফিরতেন তখন পুরা মসজিদ বাম দিকে কাত হয়ে যেতো, অ-মিয়া যিকির বলে সেগুলোকে।’

ছয়. তিনি ছিলেন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন
তিনি অসম্ভব ব্যক্তিত্বশীল ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন, তবে অহংকারী ছিলেন না। তিনি গম্ভীর ছিলেন, তবে এতোটা নয় যাতে মনে হবে তিনি কাউকে উপেক্ষা করছেন বা আত্মঅহমিকার সাথে এড়িয়ে যাচ্ছেন, তিনি কাউকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করতে, গিবত করতে ও ছিদ্রান্বেষণ করতে শোনা যায়নি। অন্তরে একটি বাইরে ভিন্ন একটা প্রদর্শনের মানুষ ছিলেন, যা বলতেন স্পষ্ট বলতেন, তিনি ছিলেন সাহসী। তাঁর মধ্যে কূটিলতা, জটিল কুটনীতি ও খেল বলতে কিছু ছিল না।

সাত. তিনি ছিলেন নির্বিতর্কিত ব্যক্ত্বিত্ব
বিভিন্ন ইস্যুতে অনেককে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বির্তকের শিকার হতে হয়, তাদের নিয়ে ট্রল হয়। আমার শায়খ সবসময়ই এসব বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি কোনো সময় তাঁর পদক্ষেপের জন্য সমালোচিত বা ট্রলের শিকার হননি।

লেখকঃ সগির আহমদ চৌধুরী



source https://deshdunianews.com/%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a6%96-%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b9-%e0%a6%a4%e0%a7%88%e0%a7%9f%e0%a6%ac-%e0%a6%b0%e0%a6%b9-%e0%a6%ac/

0 Comments